শিরোনাম: |
বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠনের এখনই সময়
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
বরিশালের ঘটনা এবং পরীমণির মামলা এই দুটি ব্যাপারই প্রমাণ করে বাংলাদেশে অবিলম্বে একটি গণতান্ত্রিক এবং শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। দীর্ঘকাল রাজনীতির মাঠ শূন্য থাকায় প্রশাসনিক ক্ষমতার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্যতা ধর্মীয় রাজনীতি এসে ফের দখল করে নিতে চাচ্ছে। আফগানিস্তানে তালেবান রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তার প্রভাব বাংলাদেশেও যে এসে পড়বে, এ আশঙ্কা খুবই স্পষ্ট। বাংলাদেশের যেসব বামপন্থি দল যেমন রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি, ইনুর জাসদ, বাসদ, সিপিবি এবং সমমনা অন্যান্য দলের উচিত, অবিলম্বে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা ভুলে একটি মাত্র লক্ষ্যে বাংলাদেশে আমলাতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা রোখাকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক মোর্চা গঠন। মন্ত্রিত্বের নেশা এবং আগামী নির্বাচনেও নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে জয়ের আশা ত্যাগ করে তারা যদি বাম গণতান্ত্রিক ঐক্যজোট গঠন না করেন, তাহলে আগামী নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তি একটা ওয়াকওভার পাওয়ার সুযোগ নেবে।
আব্বাসউদ্দিনের একটি বিখ্যাত গানের কলি হচ্ছে 'আগে জানলে তোর ভাঙা নৌকায় চড়তাম না'। দেশের বাম গণতান্ত্রিক শক্তি আমার সতর্কবাণীতে কান না দিয়ে আগামী নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকের ওপর ভরসা করলে ওপরের গানটি তাদের গাইতে হবে। আগামী নির্বাচনে কী হবে, তা কেউ বলতে পারে না। বরিশালের ঘটনায় দেখা যায়, নির্বাচিত মেয়র ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। শহরের দেয়াল থেকে পোস্টার অপসারণ করা নিয়ে দু'জনের সমর্থকদের মধ্যে প্রতাপ ও শক্তির দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল। প্রতাপ দেখানোর পরীক্ষায় নির্বাহী অফিসার প্রথমে জয়ী হয়েছেন। তার নির্দেশে পুলিশকে ধরপাকড় করতে হয়েছে। মেয়রের নামে নির্বাহী অফিসার খুন করার প্রচেষ্টার মামলা দায়ের করেন। মেয়রের পিঠে শহীদ পরিবারের ছাপ এবং ক্ষমতাসীন পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় এ যাত্রা তিনি বেঁচে গেছেন। বরিশালের মেয়র এবং তার পরিবার-পরিজন নিয়ে বরিশাল জেলার জনসাধারণের মনে অসন্তোষ রয়েছে বলেই একজন সরকারি আমলার পক্ষে তার বিরুদ্ধাচরণ করা সম্ভব হয়েছে। এরকম অভিযোগ বহু জেলা-উপজেলার আওয়ামী নেতাদের বিরুদ্ধে শোনা যায়। জনগণের নির্বাচিত নেতারা যতই জনগণের আস্থা হারাচ্ছেন, ততই আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হচ্ছে। এ সমস্যাটি সম্পর্কে আওয়ামী লীগ সচেতন বলে মনে হয় না। পরীমণিকে হেনস্তা করার জন্য নব্য ধনীরা রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করল। তার কলঙ্ক আমলাতন্ত্র কখনও বহন করবে না। করবে রাজনৈতিক সরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি, সিরাজ শিকদারকে হত্যার আদেশ বঙ্গবন্ধু দেননি। তিনি ঢাকায় তৎকালীন এসপিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাকে অভিযান চালিয়ে ধরে আনার জন্য। সিরাজ শিকদার দেশময় সর্বহারা বিপ্লবের নামে যে খুনখারাবি করে বেড়াচ্ছিলেন, তাতে বিচারে সোপর্দ হলে সিরাজ শিকদারকে এমনিতেই হয়তো ফাঁসি দেওয়া হতো। বঙ্গবন্ধু বিনা বিচারে হত্যা একেবারেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু তার অতিউৎসাহী দুই অফিসার তাকে ধরার পরে হত্যা করেন। এই হত্যার খবর যখন বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া হয়, সেদিন বঙ্গবন্ধুর চেহারা কালো হয়ে যেতে দেখেছি। পরদিন জাতীয় সংসদের অধিবেশন। সিরাজ শিকদারের প্রসঙ্গটি সংসদে উঠবেই। আমি এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলার সাহস সহসা সঞ্চয় করে উঠতে পারছিলাম না। অনেক পরে বলেছি- মুজিব ভাই, আপনি তো সিরাজ শিকদার হত্যার আদেশ দেননি। আগামীকাল সংসদে কী বলবেন? বঙ্গবন্ধু বললেন, কী বলব তাই ভাবছি। এরা (পুলিশ) আমার আদেশের অন্যথা করেছে। আমি এবার সাহস পেলাম। বললাম, এই দুই পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করা উচিত। সরকারের এই হত্যাকাণ্ডের দায় নেওয়া উচিত নয়। সরকারবিরোধীরা সংসদে নেই। কিন্তু বাইরে তারা স্ক্যান্ডাল ছড়াবে, আপনার চরিত্রে দাগ লাগাবে। বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, যারা এই গুলি চালিয়েছে, তারা আমার প্রশাসনের লোক। আমি সেই প্রশাসনের হেড হয়ে দায়িত্ব এড়াই কী করে? ওরা যদি ভুল করে থাকে, তার দায়িত্ব আমাকে এবং আমার সরকারকেই নিতে হবে। এরপর আর কথা বলা চলে না। কম্যুনিস্ট পার্টির কমরেড মণিং সিংহ এ সময় এসে গেলেন। তিনি সিরাজ শিকদারের মৃত্যুতে স্বস্তি প্রকাশ করলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখের কালো ভাব কিছুটা দূর হলো। আমি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। বর্তমান সরকারের আমলে ২৮ বছরের এক পিতৃমাতৃহীন অসহায় তরুণী পরীমণির ওপর রাষ্ট্রশক্তি যে অত্যাচার চালাল, তাকে আজ একটি তুচ্ছ ঘটনা মনে হতে পারে, ভবিষ্যতে এই অত্যাচারই বর্তমান সরকারের আমলে নারী নির্যাতনের সবচেয়ে কলঙ্ক বলে বিরোধী পক্ষ তাদের প্রচারণায় একেবারে সামনে নিয়ে আসতে পারবে। দোষ তো করেছেন ব্যক্তিবিশেষ। মোটা টাকা ব্যয় করেছেন পরীমণিকে ফাঁসাতে একশ্রেণির মিডিয়া, পরীর বুয়া ও ড্রাইভার এবং আরও নানা মহলকে বশ করার জন্য। কিন্তু এই কলঙ্কের দায় বহুকাল ধরে পোহাতে হবে বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারকে। এ জন্যই আমি সমস্যাটির গোড়াতেই প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করার জন্য খোলা চিঠি দিয়েছিলাম। আমি আমার অন্তরঢালা অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশের জাগ্রত বিবেক আইনজীবী, সমাজসেবী, নারীমুক্তির আন্দোলনের নেতা, সাংবাদিক এবং সব বুদ্ধিজীবীকে, যারা পরীমণিকে কেন্দ্র করে নারী সমাজ ও মানবতার যে অবমাননা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে আমার আন্তরিক অভিনন্দন সুলতানা কামালকে, যাকে আমি বলব মহীয়সী মায়ের যোগ্য উত্তরসূরি। তিনি এ ব্যাপারে এক টকশোতে আইনগত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, কেন পরীমণির ব্যাপারে সংবিধান লঙ্ঘন করা হয়েছে। দেশের অবস্থা ভালো নয়। কভিডের হামলা তো চলছেই। তার ওপর শুরু হয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। তাও মহামারির আকার ধারণ করেছে। এ জন্য দুর্নীতি দায়ী। বিদেশ থেকে মশা মারার তেল এনে তাতে জল মিশিয়ে ছিটানো হলে মশা সমস্যা কী করে দূর হবে। কভিড ও ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকারের চেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু ভেতর থেকে সাবোটাজ হলে সরকার কী করবে? একদিকে কভিড ও ডেঙ্গুর হামলা, অন্যদিকে একশ্রেণির মন্ত্রী, এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়রের দুর্নীতি ও ক্ষমতার ব্যভিচার। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে অশুভ শক্তির উত্থান সম্ভব। আফগানিস্তানে তালেবান আবার শাসন ক্ষমতা ফিরে পেয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতি ও হেফাজতিরা উৎসাহিত হবে। এ অবস্থায় দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষা এই দায়িত্ব কেবল আওয়ামী লীগের ঘাড়ে না চাপিয়ে দেশের বাম গণতান্ত্রিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হোক। তাদের সঙ্গে যোগ দিন দেশের সেইসব বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী, যারা কেবল খবরের কাগজে বিবৃতি দিয়ে দেশের সমস্যা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এখন সময় এসেছে দেশ সম্পর্কে দায়িত্ব পালনের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত এবং গণতন্ত্রে আস্থাশীল একটি শক্তিশালী বিরোধী দল এখনই গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। নইলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির শূন্যতা কোনো অশুভ শক্তি দখল করে নেবে। |