বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, 2০২4
সুশীল সমাজ গণতন্ত্র চান, তার ভিত্তিটা কী হবে?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Sunday, 13 December, 2020 at 10:10 PM

বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা সকলেই চেঁচামেচি করি। সবচাইতে বেশি চেঁচান আমাদের তথাকথিত সুশীল সমাজ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে দাবি করছে, দেশে তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। আর বিএনপি-জামায়াত ও সুশীল সমাজ বলছে, দেশে গণতন্ত্র নেই। আসলে দেশে এখন একটি গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে। কিন্তু গণতন্ত্র এখনো সোনার হরিণের মতো ধরা ছোঁয়ার-বাইরে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে গণতন্ত্রের একটি শক্তিশালী স্তম্ভ আবার দেশে প্রতিষ্ঠা করতে হবে—তাহলো ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতন্ত্র দেশের সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকারের কথা বলে, তা ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ছাড়া প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বঙ্গবন্ধু তাই দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় চার মৌলিক আদর্শের একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুই সামরিক শাসকের একজন সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের একটি মূল ভিত্তি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বর্জন করেন। অন্যজন ধর্মীয় বিধান যুক্ত করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিটাই ধ্বংস করে গেছেন।
সংবিধান একটি রাষ্ট্রের পরিচয় ও অস্তিত্বের রক্ষাকবচ। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকায় নব্য ফ্যাসিবাদের যে অভুত্থান ঘটেছিল, তা ক্ষমতায় পাকাপোক্ত হতে পারেনি। তার একটি বড় কারণ, শক্ত সাংবিধানিক খুঁটি। এই খুঁটি শক্ত ছিল বলেই ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের মতো আমেরিকার ট্রাম্প অনেক হইচই করেও ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় স্থায়ী করতে পারেননি। বাংলাদেশে যে বারবার সামরিক ও স্বৈরাচারী শক্তির অভ্যুত্থান ঘটেছে, তার কারণ সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধান কাটছাঁট করার সুযোগ পেয়েছিলেন, দেশের সংবিধানের খুঁটি শক্ত থাকলে দেশটির গণতান্ত্রিক চরিত্রকে সম্পূর্ণ ধর্মীয়করণে তারা সক্ষম হতেন না। এজন্য আওয়ামী লীগের উচিত ছিল ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দ্বারা তৈরি সংবিধান—’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া। সম্পূর্ণভাবে ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া। আওয়ামী লীগ তা করেনি। তারা সংবিধানকে যে অন্যায়ভাবে ধর্মীয়করণ করা হয়েছে, তার পুরো প্রতিকার করেননি বরং ধর্মীয়করণ পুরোপুরি রেখে দিয়ে কথার হেরফেরে সামান্য সংশোধন করেছেন। সেই সংশোধন দ্বারা সংবিধান তার আগের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ফিরে পায়নি। এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কোনো কোনো শীর্ষ নেতার সঙ্গে আলোচনার সময় তারা বলেছেন, দেশের মানুষ ধর্মের নামে অন্ধ। এই অবস্থায় সংবিধানকে এখনই ’৭২-এর সংবিধানে পরিণত করতে গেলে জনমত তার বিরোধিতা করত। তারা তাই সংবিধানের সংশোধনের ব্যাপারে ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছেন। সময় হলে তারা পুরোপুরি ’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবেন। আমার কাছে এই যুক্তিটি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তার কারণ, এক সময় বলা হয়েছিল, জামায়াতের শীর্ষ নেতারা, যারা একাত্তরের গণহত্যায় জড়িত ছিল, তাদের বিচার ও শাস্তি দেওয়া যাবে না। বিশেষ করে গোলাম আযম, দেলওয়ার হোসেন সাঈদীকে তো স্পর্শ করাই যাবে না। কিন্তু তাদের ধরা হয়েছে এবং বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। তাতে জনমত বিগড়ায়নি বরং সরকারকে জোর সমর্থন দিয়েছে। ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ যখন পুলিশ ভেঙে দেয় তখন প্রচার চালানো হয়েছিল, ‘তওহিদি জনতার ওপর হাসিনা সরকারের হামলা, ২০ হাজার মোমিন মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে।’ এই মিথ্যা প্রচারে কেউ কান দেয়নি। বিএনপি-জামায়াতের এই প্রোপাগান্ডা জনগণের মধ্যে কোনো সাড়া জাগায়নি। ভারতের সঙ্গে হাসিনা সরকার সাহসের সঙ্গে যত চুক্তি করেছেন, তার প্রত্যেকটির সময় বিএনপি প্রচার চালিয়েছে এগুলো দাসচুক্তি। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের সময় স্বয়ং বেগম খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘ভারতের কাছে দেশের এক-দশমাংশ বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।’ এই প্রচারণাও মাঠে মারা গেছে। বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী রাজনীতি এত শক্তিশালী ছিল যে, অনেকেই মনে করেছেন, শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে বেশি দূর এগুতে পারবেন না। শেখ হাসিনা সাহসের সঙ্গে এগিয়ে ভারতের সঙ্গে যেমন অসংখ্য সাহায্য ও সহযোগিতার চুক্তি করেছেন, তেমনি বাংলাদেশে ভারত-বিদ্বেষী রাজনীতির অবসান ঘটিয়েছেন। এখন বিএনপিও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষার কথা বলে। হাসিনা সরকার এখন দেশে যাতে সামরিক অভ্যুত্থান না ঘটে সেজন্য আইন করেছেন। বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে গেলে এই আইন করতে হতো না। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারাটি বলবৎ থাকলে নতুন হেফাজতিদের ভাস্কর্য ভাঙার অপরাধের সঙ্গে সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বিচারে সোপর্দ করা যেত। ‘গণতান্ত্রিক সংবিধান গণতন্ত্র রক্ষার শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ’—কতাটা বলেছিলেন পাকিস্তানের গণপরিষদের এক সাবেক স্পিকার তমিজউদ্দীন খান। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ সেনা প্রধান জেনারেল আইয়ুব খানের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নাজিমউদ্দীন মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করেন এবং গণপরিষদও ভেঙে দেন। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানের সংবিধান তৈরি হয়নি এবং ব্রিটিশ আমলের ১৯৩৫ সালের শাসন-সংস্কার বিধি দ্বারা পাকিস্তানের শাসনকার্য চলছিল। বাতিল গণপরিষদের স্পিকার ছিলেন তমিজউদ্দীন খান। তিনি সাহসের সঙ্গে গোলাম মোহাম্মদের অবৈধ কাজের প্রতিবাদ করেন এবং সিন্ধু হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই মামলায় সিন্ধু হাইকোর্ট রায় দেন গোলাম মোহাম্মদের কাজ অবৈধ এবং একটি সংসদীয় সরকারকে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ না হলে বড়লাটের ভেঙে দেওয়ার অধিকার নেই। গোলাম মোহাম্মদ সুপ্রিম কোর্টে সিন্ধু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস তখন ছিলেন জাস্টিস মুনীর। তিনি ভয় করছিলেন তিনি বড়লাটের আপিল নাকচ করে দিলেও সামরিক বাহিনীর সহায়তায় গোলাম মোহাম্মদ সেই রায় মানবেন না। হয়তো সুপ্রিম কোর্টও বাতিল করে দিতে চাইবেন। তিনি যুক্তি দেখালেন, ‘বিপ্লব যদি সফল হয়, তাহলে বৈপ্লবিক শক্তির ক্ষমতা দখল বৈধ।’ একটি আধা মিলিটারি ক্যুকে পাকিস্তানের চিফ জাস্টিস এভাবে বিপ্লব অ্যাখ্যা দিয়ে গোলাম মোহাম্মদের অবৈধ কাজকে বৈধতা দেন। জাস্টিস মুনীরের এই রায়ে হতাশ হয়ে তমিজউদ্দীন খান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, এই রায় পাকিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমাদের যদি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান থাকত এবং রাজনীতিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই সংবিধান রক্ষা করতে পারতেন, তাহলে পাকিস্তানে কেউ সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের দুঃসাহস দেখাত না। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তানের কোনো সংবিধান ছিল না। কিন্তু ১৯৫৬ সালে একটি সংবিধান তৈরি হয় এবং ঐ সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তান শাসিত হচ্ছিল। কিন্তু সেই সংবিধানও লঙ্ঘন করে জেনারেল আইয়ুব ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। এবারেও রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংবিধান রক্ষা করতে পারেনি। বরং মুসলিম লীগ বিভক্ত হয়ে এক অংশ আইয়ুবের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল।
স্বাধীন ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে জেনারেল জিয়া, আইয়ুবের কায়দায় সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর সংবিধানের চরিত্র হননের কাজে হাত দেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা বাতিল করে বাংলাদেশ যে মৌলিক আদর্শের ভিত্তিতে স্বাধীন হয়েছে, সেই মৌলিক আদর্শটাই বাতিল করে দেন এবং রাষ্ট্র ও সমাজের সাম্প্রদায়িকীকরণ শুরু হয়। সেই বিষবৃক্ষের চারা আজ মহিরুহে পরিণত হয়েছে। সংবিধানের ধর্মীয় চরিত্রের শক্তিতেই আজ হেফাজতিরা বাংলাদেশে ভাস্কর্য তৈরি ধর্মবিরোধী স্লোগান তুলে তা ভাঙার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। আমেরিকায় দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দল। কিন্তু দেশের সংবিধানের পবিত্রতা রক্ষায় দুটি দলই অঙ্গীকারাবদ্ধ। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন সংবিধান লঙ্ঘন হয় এমন সব কার্যকলাপ শুরু করেছিলেন, তখন তার রিপাবলিকানদেরও একটি অংশ তাতে বাধা দিয়েছে। এখন নির্বাচনে পরাজয় না মেনে ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকার যে পাঁয়তারা শুরু করেছিলেন, তাতে সমর্থন জোগায়নি রিপাবলিকান দল। এজন্যই বলা হয়, মার্কিন গণতন্ত্রের রক্ষা কবচ দুটি। একটি শক্ত সংবিধান, অন্যটি শক্তিশালী কংগ্রেস। বাংলাদেশে সব রাজনৈতিক দল মিলে সংবিধানের মূল চরিত্র ধ্বংস করার কাজে জিয়াউর রহমান ও হোসাইন মুহম্মদ এরশাদকে বাধা দিতে যদি আন্দোলন গড়ে তুলতে পারত অথবা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাহাত্তরের সংবিধানের পুনর্বহালের দাবি আদায় করত, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থা আজ অন্যরকম হতো। বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় গিয়ে প্রথমে সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরে যেতে রাজি ছিল না। কিন্তু তখনকার ১৮-দলীয় ঐক্যজোটের চাপে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে রাজি হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বাহাত্তরের অবিকৃত সংবিধানে ফিরে যেতে বিএনপিকে রাজি করতে পারলে পরবর্তী অনেক দুর্যোগ থেকে দেশ সম্ভবত বেঁচে যেত। দেশে দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারা ফিরে আসত।
 আওয়ামী লীগও ২০০৮ সালে যে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তাতে সংবিধানে বাহাত্তরের পূর্ণ চরিত্র ফিরিয়ে আনা কোনো কঠিন কাজ ছিল না। সম্ভবত নিজেদের দুর্বলতার জন্যই সংবিধানের যে সংশোধন তারা করেছে, তা লোক দেখানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর বাহাত্তরের ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চরিত্র সংবিধানে ফিরে আসেনি। আমাদের সুশীল সমাজ গণতন্ত্রের জন্য চেঁচান। একটা ধর্মীয় চরিত্রের সংবিধানের অধীনে তারা দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার আশা কি করেন? আওয়ামী লীগের সরকারও কি বারবার হেফাজতিদের উত্থান ঠেকাতে পারছে?


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি