শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
ভ্যাকসিন আসছে : মৃত্যু ব্যবসায়ীরাও সিন্ডিকেট গড়ছে
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Monday, 7 December, 2020 at 7:54 PM

একটা মস্ত বড় সুখবর- ভ্যাকসিন আসছে। মৃত্যুদানব কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধক অথবা প্রতিরোধক ভ্যাকসিন এসে গেছে। পৃথিবীর সব দেশের মধ্যে ব্রিটেনেই প্রথম এ ডিসেম্বর মাসেই সব নাগরিককে ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হচ্ছে। এ ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যাপারে প্রায়োরিটি দেয়া হবে বুড়ো-বুড়িদের। আমেরিকার ফাইজার কোম্পানির এ ভ্যাকসিনটির রোগ প্রতিরোধ শক্তি পরীক্ষিত ও প্রমাণিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।

এ খবর শুধু ব্রিটেনেই নয়, সারা পৃথিবীতেই মানুষের মনে স্বস্তির ভাব ফিরিয়ে এনেছে। মানুষ তো সমুদ্রে পড়লে তৃণখণ্ড অবলম্বন করেও বাঁচতে চায়।
কিন্তু এ ভ্যাকসিন রাতারাতি সমস্যার সমাধান করবে না। ব্রিটেনের চিফ মেডিকেল অফিসার সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, এ ভ্যাকসিন এখন দেয়া শুরু করলে আগামী বছরের এপ্রিল মাস থেকে সুফল আসতে শুরু করবে। কিন্তু তার আগে এ তিন মাসব্যাপী ইউরোপিয়ান উইন্টারে কোভিড-১৯-এর যে তৃতীয় দফা ঢেউ আসছে, তা এ ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া রোধ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। সুতরাং ভ্যাকসিন নেয়া মাত্র ক্রিসমাসসহ কোনো উৎসবে যেন জনসমাবেশ না হয়, মানুষ যাতে সোশ্যাল ডিসট্যান্সসহ করোনাকালীন নিয়মকানুন কঠোরভাবে আরও কিছুকাল মেনে চলে সেজন্য তিনি ব্রিটেনের নাগরিকদের সতর্ক করে দিয়েছেন। অবশ্য এ সতর্কতা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্যই।

বিপদ সংকেত আরও আছে এবং সেটা কোভিডের ভ্যাকসিন সংক্রান্ত বিশ্বের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সারা বিশ্বের মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে। কোভিডের টিকা যেমন বাজারে বের হতে যাচ্ছে, তেমনি তার ভেজাল বা নকল বের করার কয়েকটি বিশ্ব-সিন্ডিকেট তৈরি হয়ে গেছে। এ মার্চেন্ট অব ডেথ বা মৃত্যু ব্যবসায়ীরা বিশ্বময় তাদের নকল ভ্যাকসিনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। তাদের খপ্পরে উন্নত দেশগুলোর চেয়ে আধা উন্নত ও উন্নয়নশীলগুলোরই পড়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মধ্যেই ভেজাল ওষুধের মার্কেট বড়। এসব দেশে ভণ্ডপীরদের পানিপড়া, তাবিজ-তুমারেও মানুষ বেশি বিশ্বাস করে।

বাংলাদেশ এ উন্নয়নশীল দেশগুলোরই একটি। ভেজাল খাদ্য, নকল ওষুধের বড় মার্কেট বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই। এসব দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের মনুষ্যত্ববোধ ও বিবেক বলতে কিছু নেই। এরা শিশুখাদ্যে, জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও জেনেশুনে বিষাক্ত ভেজাল মেশাতে লজ্জাবোধ করে না। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাবের সময় মাস্ক নিয়ে চোরাচালানি এবং হাসপাতালে রোগীদের ভুয়া চিকিৎসার নাম করে মাত্র এক ব্যক্তিরই কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির খবর বেরিয়েছিল এবং দুর্বৃত্ত ধরাও পড়েছিল।

ব্রিটিশ আমলে হাজার হাজার টন খাদ্যদ্রব্য গুদামে লুকিয়ে রেখে এ মৃত্যু ব্যবসায়ীরা ৫০ লাখ নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছিল। এ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠলে বিচারে সোপর্দ হবেন, এ ভয়ে তৎকালীন বাংলার ইংরেজ গভর্নর স্যার জন হার্বাট আত্মহত্যা করেছিলেন বলে তখন শোনা গিয়েছিল। ব্রিটেনে যখন এ মাসেই কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হতে যাচ্ছে, তখন ইউরোপের অন্যান্য দেশও এ ব্যাপারে পিছিয়ে থাকবে না। তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর আগে ব্রিটেন ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করতে পারায় বরিস জনসনের মন্ত্রীরা এর রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা শুরু করেছেন।

তারা বলছেন, ব্রেক্সিট না হলে ব্রিটেনকে এখনও ভ্যাকসিনের ব্যাপারেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের লেজে বাঁধা থাকতে হতো এবং নিজেদের ইচ্ছামতো আগেই এ ভ্যাকসিন দেয়া শুরু করতে পারত না। লন্ডনের ‘গার্ডিয়ান’ এটাকে বলেছে ভ্যাকসিন-রাজনীতি এবং মানুষের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ নিয়ে এ ধরনের রাজনীতি না করার জন্য বরিস জনসনের মন্ত্রীদের সতর্ক করে দিয়েছে। গার্ডিয়ান বলেছে, করোনার টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে মাত্র। এখন এর কার্যকারিতা দেখা, ন্যাশনওয়াইড এ টিকা দেয়ার ব্যবস্থা সফল করা, ডাক্তার-নার্সদের এ টিকা দানে ট্রেনিং দেয়া এবং এ টিকার যে বিরাট চাহিদা দেখা দিতে যাচ্ছে তা যথাসময়ে পূরণের দক্ষতা দেখানোর কাজে সরকারকে সাফল্য প্রদর্শনের জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে।

এ প্রস্তুতির কাজে দক্ষতা না দেখিয়ে সরকার যদি ভ্যাকসিন দেয়ার ব্যাপারটাকে নিজেদের দলীয় স্বার্থে রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার করতে থাকে, তাহলে তা হবে জাতির জন্য এক ট্র্যাজেডি। গার্ডিয়ানের এ সতর্কবাণী বাংলাদেশের জন্য আরও বেশি খাটে। আমাদের মন্ত্রীরা যদি টিকা আমদানি করেই বগল বাজাতে শুরু করেন- আমরা ওষুধ এনে করোনাজর্জরিত জাতিকে বাঁচিয়েছি এবং আমরা জাতির ত্রাণকর্তা, তাহলে তারা ভুল করবেন। একথা সত্য, দেশের করোনা-পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হাসিনা সরকার বিশ্বময় প্রশংসিত হয়েছে।

তা সত্ত্বেও করোনার হাসপাতাল-চিকিৎসায় এক শ্রেণির হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকের দুর্নীতি জাতির মাথা হেঁট করেছে। এখন দেখতে হবে ভ্যাকসিন আমদানি নিয়ে দুর্বৃত্তদের সিন্ডিকেট যেন কোনো ধরনের দুর্নীতি করার সুযোগ না পায়। আমাদের ওষুধ ব্যবসা ও রোগ চিকিৎসায় এক শ্রেণির ওষুধ ব্যবসায়ী ও চিকিৎসকের দুর্নীতি এখন বিশ্ববিদিত। আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে চ্যাম্পিয়নশিপের মেডেল দিতে হয়। জনগণের এখন একটাই আশা, করোনার ভয়াবহ মরণ ছোবলের পর দেশের মার্চেন্টস অব ডেথ বা মৃত্যু ব্যবসায়ীদের দমনের ব্যাপারে সরকার যেন কঠোর থেকে কঠোরতর হয়।

করোনার সঙ্গে এবার বন্যা ও প্লাবনেরও মরণ ছোবল ছিল দেশে। একটাই সুখবর, পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হতে চলেছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় তাতে অভূতপূর্ব উন্নতি হবে। এবার দেশের কৃষি ফলনও হয়েছে ভালো। কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাককে ধন্যবাদ, তার কৃষিনীতি দুটি মৌসুমে দেশের কৃষকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। ফলন হয়েছে ভালো। বারো আনা ফসলই বন্যার গ্রাস থেকে রক্ষা করে কৃষকের ঘরে তুলে দেয়া সম্ভব হয়েছে।

করোনার জন্য সারা বিশ্বে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হতে যাচ্ছে। গত শতকের ত্রিশের ভয়াবহ মন্দা ঠেকাবার জন্য আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট তার নিউ ডিল পলিসি প্রবর্তন করে সফল হয়েছিলেন এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। বর্তমানে আমেরিকার অর্থনীতি করোনা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের তুঘলকি নীতির জন্য দারুণভাবে বিপর্যস্ত। আমেরিকা বিশ্বনেতৃত্বও হারিয়েছে।

ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রেসিডেন্ট-ইলেক্ট বাইডেন ঘোষণা করেছেন, বিপর্যস্ত আমেরিকার অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং আমেরিকার বিশ্বনেতৃত্ব তিনি রুজভেল্টের নিউ ডিলের মতো পলিসি প্রবর্তন করে উদ্ধার করবেন। আমেরিকার সাধারণ মানুষ বাইডেনের ঘোষণায় আশাবাদী। কিন্তু তাদের ভয়, ট্রাম্পের হঠকারিতা এবং তার শ্বেত সন্ত্রাস আবার না আমেরিকার উন্নতির রথ উল্টে দেয়। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের আমলে দেশের যে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে, করোনা ও পৌনঃপুনিক বন্যা তা কিছুটা ম্লান করেছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বাংলাদেশ তার কৃষি অর্থনীতির শক্তির জোরে এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবে। এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি ও ধর্মান্ধতা।

জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অর্থনৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই সরকারের আমলে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু সরকারের কোনো সাফল্যই টেকসই নয়। তার মূল কারণ আমলাতন্ত্রের দারুণ দুর্নীতি এবং তাদের দীর্ঘসূত্রতার লালফিতা।’ সরকার যে লাল ঘোড়া দাবড়িয়েও এ দুর্নীতি দূর করতে পারছে না, তার মূল কারণ, তার প্রশাসন ও দলে দারুণ দুর্র্নীতি। আমাদের অর্থনীতিবিদ ড. বারকাতের অভিমত, একটি সমাজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ ছাড়া শেখ হাসিনার পক্ষে এ দুর্নীতি দমন করা সম্ভব নয়।

শুধু সমাজ বিপ্লবের গণতান্ত্রিক কর্মসূচি গ্রহণ করলেই চলবে না। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তার যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মী দরকার হবে। কিন্তু তার চারপাশে এ যোগ্য ও নিবেদিতপ্রাণ সহকর্মী এখন কোথায়? তিনি লাল ঘোড়া দাবড়াবেন? সেই ঘোড়াই মাঠের ঘাস খেয়ে ফেলবে। শেখ ফজলুল হক মণি আমাকে একবার একটি কথা বলেছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘গাফ্ফার ভাই, আইয়ুব ও মোনেমের প্রশাসন দ্বারা বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না।’ কথাটা যে কত সত্য, ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডির পর বুঝতে পেরেছিলাম। এখন মনে প্রশ্ন জাগে জিয়া-এরশাদ-খালেদার প্রশাসন যন্ত্র দ্বারা কি শেখ হাসিনা তার পিতার কাক্সিক্ষত সোনার বাংলার বাস্তবায়ন করে যেতে পারবেন? লাখ টাকার নয়, বিলিয়ন ডলার কোশ্চেন। উত্তর দেয়ার হিম্মত কার আছে?


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি