শিরোনাম: |
নারী ধর্ষকদের যে শাস্তি দেওয়া উচিত
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। স্কুল, কলেজে ইভটিজিং তো আছেই, তার সঙ্গে আছে সর্বত্র নির্যাতন ও ধর্ষণ। সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীসহ বেড়াতে গিয়ে এক নারী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ধর্ষণকারীরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বলে জানা গেছে। গত বছর বৃহত্তর বরিশালের বরগুনায় ঘটেছিল আরেকটি ঘটনা। সেটা ধর্ষণ নয়। প্রকাশ্য দিবালোকে কলেজের সামনে এক ছাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী (কলেজের ছাত্রী) তখন স্বামীর সঙ্গে ছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডে আওয়ামী লীগের লোকাল এক এমপির মাস্তান ছেলে জড়িত ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু স্বামী হত্যার চক্রান্তে জড়িত থাকার দায়ে পুলিশ গ্রেপ্তার ও হেনস্তা করে ওই ছাত্রীটিকে। এর বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ওঠে। শেষ পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই ছাত্রীর ফাঁসির আদেশ হয়েছে।
নারী নির্যাতনের ঘটনা দেশে প্রায়শই ঘটছে। বরং বলা চলে দ্রুত বাড়ছে। বিয়ের বা সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশে আগে মেয়েদের মুখ বা শরীর অ্যাসিড মেরে ঝলসে দেওয়া হয়েছে। কাগজের রিপোর্ট পড়ে মনে হয়, সেটা এখন একটু কমেছে। কিন্তু দ্রুত হারে বাড়ছে ধর্ষণের সংখ্যা। নারীরা শহরে-বন্দরে-গঞ্জে-গ্রামে কোথাও নিরাপদ নেই। কোরআন শিক্ষা করতে আসা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীর ওপর একশ্রেণির ইমামের যৌন অত্যাচারের কাহিনিও খবরের কাগজে পাঠ করছি। আর মাদ্রাসায় ছাত্রী নির্যাতনও এখন অন্যতম প্রধান ঘটনা। কিছুদিন আগে ফেনীর এক মাদ্রাসায় খতিবের লালসা পূরণের কাজে সম্মত না হওয়ায় এক কিশোরীকে নির্মমভাবে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। তাতে সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। হত্যাকারীদের রক্ষার কাজে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেউ কেউ। এমনকি স্থানীয় থানার তখনকার ওসি। তারা অবশ্য শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু এই শাস্তি এই বর্বর নারীর নির্যাতনের বিস্তৃতি রোধ করেনি। খবরের কাগজে নারী নির্যাতনের খবর দেখে আমরা বলছি দেশে এ অপরাধ বেড়েছে। কিন্তু প্রকাশিত খবরের বাইরে এবং দেশের গ্রামাঞ্চলে নানাভাবে যে নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন চলছে, তার প্রকৃত সংখ্যা জানা গেলে আমরা শিহরিত হতাম। ধানক্ষেতে, পাটক্ষেতে অল্প বয়সের মেয়েদের টেনে নিয়ে ধর্ষণ ও হত্যা তো সেই প্রাচীনকাল থেকে চলছে। এ যুগে একশ্রেণির অন্ধ মোল্লার ফতোয়ায় অসংখ্য তরুণীকে জনসমক্ষে বেত্রাঘাতে হত্যার কাহিনি এখনও বিরল নয়। সরকার অবশ্য এ ব্যাপারে এখন সচেতন হয়েছে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। কিন্তু একশ্রেণির মোল্লার ফতোয়া বিচারে গ্রামাঞ্চলের অজ্ঞ জনসমাজের অনুমোদন থাকার ফলে এই নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে সরকারি প্রচেষ্টা সব সময় সফল নয়। এখন দেখা যাচ্ছে, শহরাঞ্চলের শিক্ষিত ও ধনী তরুণ প্রজন্মের এক বিরাট অংশের মধ্যেও নারী ধর্ষণের প্রবণতা বেড়েছে। জন্মদিনের পার্টির নাম করে নিজের সহপাঠী ছাত্রী বন্ধুকে হোটেলে ডেকে নিয়ে ভাড়া করা নির্জন কক্ষে তাকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বীভৎস কাহিনিও খবরের কাগজে পাঠ করেছি। একশ্রেণির শিক্ষক ও অধ্যাপকও সুযোগমতো তাদের সুন্দরী ছাত্রী ধর্ষণ থেকে বিরত নন। নারী শ্রমিক প্রায়মই ধর্ষিত হচ্ছেন। উচ্চপদে চাকরি করতে গিয়ে শিক্ষিতা মেয়েরাও যৌন হেনস্তার শিকার হন। অনেক অফিস সেক্রেটারি ও অ্যাসিস্ট্যান্টকে বসকে 'খুশি' রেখে চাকরি বজায় রাখতে বাধ্য করা হয়। উন্নত পাশ্চাত্য দেশেও নারীর নিরাপত্তা কম। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্রিটেনে অফিস-আদালতে কাজ করেন এমন নারীর শতকরা ৭০ ভাগ কোনো না কোনো ধরনের যৌন হেনস্তার শিকার। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে- এমনকি অক্সফোর্ড এবং হার্ভার্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়েও ডেট-রেপ একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। একশ্রেণির ছাত্র তাদের সহপাঠী বা চেনাজানা ছাত্রী বন্ধুকে পাবে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যায়, তারপর গোপনে তার ড্রিঙ্কসে ড্রাগস মিশিয়ে তাকে অর্ধচেতন করে হোস্টেলের কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করে। হলিউডের দুই ফিল্ম মোগল বিখ্যাত তারকাদের নানা প্রলোভনে ভুলিয়ে কীভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার করেছেন, তার রসালো গল্প তো এখন প্রতিদিন আমেরিকা, ইউরোপের কাগজের প্রধান খবর। এই ফিল্ম মোগলদের একজন তো এখন বহু নারী ধর্ষণের অপরাধে জেল খাটছেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারে রানীর দ্বিতীয় পুত্র প্রিন্স এনড্রুজের বিরুদ্ধে নাবালিকা ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। তিনি এই অভিযোগ থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেননি। নারী-আসক্তির দায়ে আমেরিকায় বহু রাজনৈতিক নেতার রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়েছে। ব্রিটেনে বহু প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে। মিসেস মার্গারেট থ্যাচার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে নারী-আসক্তির দায়ে অভিযুক্ত তার এক মন্ত্রী সম্পর্কে বলেছিলেন, 'হি ওয়াজ অলসো ট্রাইং টু চ্যাটিং মি আপ' (তিনি আমাকেও প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন)। এটাই হচ্ছে উন্নত-অনুন্নত নির্বিশেষে সব দেশে নারী সমাজের অবস্থান। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা নারীর অভূতপূর্ব ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে বিশ্বে প্রশংসা অর্জন করেছেন। কিন্তু নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের অপরাধ কমাতে পারেননি। বরং তা বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারতে এই সমস্যা আরও ভয়াবহ। দিল্লিতে নির্ভয়া হত্যাকাণ্ডের পর ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের পরও নারী ধর্ষণ ব্যাপক হারে বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি এক পুলিশ রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালে ৯২ দিনে ৩৩ হাজার ৬৫৮ জন নারী ধর্ষিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে অধিকাংশ দলিত বা অচ্ছুৎ (মহাত্মা গান্ধীর তথাকথিত হরিজন শ্রেণি) শ্রেণির লোক। গত সপ্তাহেও উত্তর প্রদেশে দলিত শ্রেণির ১৯ বছরের এক তরুণী সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ফলে মারা গেছেন। ফলে নির্ভয়া হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মতো উত্তাল হয়ে উঠেছে গণমানুষ। এই বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকারকে ১৪৪ ধারা জারি করতে হয়েছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং তার বোন প্রিয়াঙ্কা ধর্ষিত তরুণীর পরিবারকে সমবেদনা জানাতে তাদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। তাদের দু'জনকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমি নারী ধর্ষণের দায়ে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড দানের পক্ষপাতী। এই ধর্ষকরা বর্বর এবং ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু সেইসঙ্গে এও জানি, কেবল কঠোর আইন ও পুলিশের দ্বারা এই অপরাধ দমন করা যাবে না। আমাদের সামন্তবাদী সমাজে তো নারী ভোগের বস্তু। ধনতান্ত্রিক সমাজে নারী মুক্তি ঘটেছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু ধনতন্ত্রের উন্নত দেশেও নারীদেহ পণ্যের বিজ্ঞাপনে উলঙ্গভাবে ব্যবহার করে তারা তাদের মুনাফা-বাড়ানোর কাজে লাগান। পুরোনো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো, যেমন- সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবায় নারী ধর্ষণ প্রায় বিলুপ্ত করা হয়েছিল, তারা ব্যাপক নারী শিক্ষা ও নারী স্বাধীনতার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিউবায় নারী শিক্ষায় বাধ্যতামূলকভাবে কুংফু ও অন্যান্য আত্মরক্ষার পদ্ধতি শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারতের মতো দেশেও ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে নারীকে মুক্ত করে তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ফিজিক্যাল ট্রেনিংসহ কুংফু জাতীয় আত্মরক্ষার প্রণালি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। শুনেছি, সম্ভবত আমেরিকার একটি রাজ্যে নারী ধর্ষণের দায়ে অপরাধী প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ডদানের বদলে তাদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলা বা দেহে যৌনক্ষমতা বিলুপ্ত করার ব্যবস্থা করা হয়। এই দাওয়াইটি আমাদের দেশেও প্রবর্তন করা হলে কেমন হয়? |