শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
ফেনীর সেই ডিসি সোলায়মান এখন জামায়েতের প্রধান শত্রু
Published : Wednesday, 29 April, 2020 at 1:28 PM

জয়নাল হাজারী ॥
 সোলায়মান চৌধুরী ফেনীর ডিসি হিসেবে নিয়োগ পায় ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তখনকার তত্তবাধায়ক সরকার অনেক আগে থেকেই তাকে ফেনীর ডিসি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল। জামায়ত ঘরনার এই লোকটি তখন বিএনপিরও সমর্থন পেয়েছিল। আমাকে উৎখাত করার জন্য এই সোলায়মান ছাড়া তখন তারা আর কাউকে খুজে পায়নি। ফেনীতে ডিসি হিসেবে যোগ দিয়েই সে শুরু করে আ.লীগ নিধন অভিযান। একের পর এক বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে সে আ.লীগকে এক প্রকার কোণঠাসা করে ফেলে। এক পর্যায়ে সোলায়মানের পরিকল্পনায় আমার বাড়িতে অভিযান চালানো হয়।

 এই অভিযানে ১৮০০ পুলিশ এবং বিডিআর অংশ নিয়েছিল। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনীও নিয়োগ করেছিল। সকল প্রকার তৎপরতা থেকে পরিষ্কার বুঝা যায় আমাকে হত্যা করার জন্যই এই অভিযানটি চালানো হয়েছিল। কিন্তু অত্যন্ত গোপনে সোলায়মানের এই পরিকল্পনার কথা আমি জানতে পারি এবং ফেনীশহর ত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যেতে সফল হই। এদিকে আমি নেত্রীর গাড়িতে আছি এই খবরের ভিত্তিতে হাজারী রোডে নেত্রীর গাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়। আমার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে আমার একটি লাইসেন্স করা টুটু রাইফেল ছাড়া তারা অন্য কোন অস্ত্র পায়নি। তথাপি যে সকল বিডিআর সদস্য সেদিন আমার বাড়িতে অভিযানে অংশ নিয়েছিল তাদের হাতে থাকা অস্ত্রগুলোকেই আমার দেখানো হয়। আরো অনেক কিছু অবৈধ পাওয়া গেছে বলে বেশ কয়েকদিন ধরে টেলিভিশনে এবং পত্র-পত্রিকায় প্রচার হতে থাকে। এই সময়ের অবৈধ অস্ত্র ও মালামালের জন্য আমার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয় এবং বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই মামলায় আমার ৩০ বছরের সাজা দেয়া হয়। এদিকে সেই অভিযানের পর থেকে সারা ফেনীজেলায় এক দিকে প্রশাসন ও অন্যদিকে বিএনপি ক্যাডারদের অত্যাচার নির্যাতনে অনেক আ.লীগ নেতাকর্মী নিহত হয় অনেকেই ঘর ছাড়া হয়।

এক পর্যায়ে এই সোলায়মান আমাকে দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ জারি করে। এদিকে চন্দ্রপুরের একটি খুনের মামলায় আসামী করা হয় এছাড়াও চরইঞ্জিমানে ২৪ ডাকাত হত্যা মামলায়ও আমাকে প্রধান আসামী করা হয়। ডাকাত হত্যা মামলায় চট্টগ্রামের বিশেষ আদালত থেকে আমি এবং ওবায়দুল কাদেরের ভাই মির্জা কাদের খালাস পাই। চন্দ্রপুরের মামলায় জর্জকোর্ট সকল আসামিকে খালাস দেয়। ৩০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত মামলায় হাইকোর্ট আমাকে বেকসুর খালাস দেয় ২০০৯ সালে।  ২০০১ সালের নির্বাচনেও আমাকে দলের মনোনয়ন দেয়া হয় কিন্তু আমাদের কর্মীরা কোথাও মাঠে গিয়ে কাজ করতে পারেনি। সভাসমিতি তো দূরের কথা। ২-৩জন কর্মীও এক হতে পারেনি। নির্বাচনের দিনের এজেন্টদের জন্য দেয়া দলের টাকাটাও তারা ছিনিয়ে নেয়। নির্বাচনের দিন কোথাও আমাদের একজন এজেন্টও বসতে দেয়া হয়নি। সব খানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। আমাদের বর্ষীয়ান নেতা দাগনভূঞা আ.লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন সাহেবকে দুপুরের দিকে হাত পা বেধে আতাতুর্ক স্কুল মাঠে শুয়িয়ে রাখা হয়। একইভাবে পাচগাছিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুনকেও হাতপা বেধে ফেলে রাখা হয়। মোটকথা ভোটেরদিন নির্মম নির্যাতনের মুখে আমার সকল শ্রেণীর নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিতে বাধ্য হয়। বিভিন্ন কেন্দ্রে এই সোলায়মান নিজে গিয়ে ভোটের ফলাফল বদলে দিয়েছে। কিছু কিছু কেন্দ্রে প্রিসাইডিং অফিসারদের গালাগাল করেছে। ভোটের পরিবেশ আমার পক্ষে থাকলেও ডিসি সোলায়মান সব কিছু ভন্ডুল করে দেয়। শত অত্যাচার নির্যাতনের মুখেও আমি সেদিন অনুপস্থিত থেকেও ৮০,০০০ হাজার ভোট পেয়েছিলাম। এতে সোলায়মান ও বিএনপির নেতাকর্মীরা বিস্মিত হয়। এদিকে গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র নেত্রীকে জানিয়েছিল ভোটের রেজাল্ট হাজারীর পক্ষে থাকলেও ভোট গণনার সময় নৌকার পক্ষে কেউ না থাকায় সোলায়মানের নির্দেশে ফলাফল পরিবর্তন করা হয়েছে। আমার বাড়িতে অভিযানের সময় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং এক বছর পর্যন্ত বাড়িতে পুলিশ পাহারা ছিল।

 নির্বাচনের পরও সে একের পর এক আমার চিহ্ন মুছে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথমে সে আমার প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক হাজারিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। মহামান্য হাইকোর্ট ২০১০ সালে তার এই আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করলে পত্রিকাটি আবারও চালু হয়। ডিসি অফিস থেকে হাইওয়ে পর্যন্ত এক কি.মিটারের একটি রাস্তা আমি ২৪ ঘন্টার মধ্যে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নির্মান করেছিলাম। সেই রাস্তাটির কারণে ডিসি অফিস থেকে তাদের বাসভবনের যেতে সময় লাগে মাত্র ১০ মিনিট আগে ঘুরে আসেতে ১ ঘন্টা লেগে যেত। রাস্তা করার আগে ঐ এলাকার জমির দাম ছিল ৫০০০ হাজার টাকা রাস্তা করার পর ২০১০ সালে সেখানে জমির দাম হয়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। ফলে রাস্তার দুই পাশের মানুষ রাতারাতি বিত্তবান হয়ে উঠে। এই রাস্তাটি আমার নামেই করা হয়েছিল কিন্তু ডিসি সোলায়মান সেই নামটাও পরিবর্তন করে। এভাবে তাকে দেয়া সকল দায়িত্বই সে সফলভাবে পালন করে। সে আমার বিরুদ্ধে একটি গাড়ি চুরির মামলা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে কাগজপত্র দেখে তা প্রত্যাহার করে। এই সোলায়মান জামায়েতের একজন কট্টর ক্যাডার এই কথাটি আমাকে লাকসামের তাজুল ইসলাম বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী টেলিফোনে জানিয়েছিলেন এবং আমাকে খুব সাবধান থাকতেও বলে দিয়েছিলেন। আ.লীগ নিধন করার জন্য সে শত শত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। আমি যখন ২০০৯ সালে দেশে ফিরে আসি তখন দেখলাম এহেন রাজাকার সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে অদিষ্টিত আছেন। একদিন তার অফিস কক্ষে প্রবেশ করলে সে দাঁড়িয়ে আমাকে ছালাম দেয়। আমি বলেছিলাম আমাকে দেখা মাত্র গুলি না করে দেখা মাত্র ছালাম দিলেন এটাই নিয়তির বিধান। সে ফেনীতে কঠোর হস্তে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে আ.লীগকে একেবারেই কোণঠাসা করার পুরস্কার হিসেবে অতিদ্রুত ডিসি থেকে সচিব পদে পদন্নতি পায়। এই সোলায়মান ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব, পাটকল সংস্থার চেয়ারম্যান, সর্বশেষ রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থেকে অবসরে যান। এই সোলায়মান চৌধুরী ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর জামায়েত ইসলামের সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। এর অর্থ হলো সোলায়মান চৌধুরী তার চাকরি জীবনের সকল পর্যায়ে জামায়েত ইসলামের সদস্য ছিল।

যদিও তখন বিষয়টি লোকচুর অন্তরালেই ছিল কিন্তু এই লোকটি ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পুলিশ লাইনের বিপরীতে অবস্থিত হোটেল রেডিস্টাওে আসতো। এ সময় সে নূর ইসলাম, একরাম, খোকন, মালেক বিএসসিসহ অনেকের সাথেই রাতকে রাত তাস খেলায় পড়ে থাকতো। রাজস্ব বোর্ড থেকে অবসরে যাওয়ার পর বেশ কয়েক বছর সে অনেকটাই আত্মগোপনে ছিল। ২০১৯ সালে তাকে আবার জামায়েতের রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় হতে দেখা যায়। কিন্তু শেষ মূহুর্তে এই সোলায়মান বর্তমানে জামায়েতের গলাও ছুরি বসাবার জোরালো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জামায়েত এখন দ্বিধা-বিভক্তির পথে। মনে হয় জামায়েতকে বড় ধরনের ভাঙনের মুখ থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সাবেক সচিব সোলায়মান চৌধুরির নেতৃত্বে জনআকাক্সাক্ষার নামে জামায়েত ভেঙ্গে একটি নতুন দল আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। গত সোমবার নতুন দলের নাম ঘোষনা উপলেক্ষ সেগুনবাগিচার একটি কেন্দ্রীয় কার্যলয়ে বৈঠক করেন নেতারা। এই বৈঠকেই শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে দলে নাম ঘোষণার কথা চূড়ান্ত করা হয়। সোলায়মান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জনআকাক্সাক্ষার প্রধান সমন্নায়ক মজুবুর রাহমান মঞ্চু। কেন্দ্রীয় সংগঠক অধ্যাপক ড. মেজার ওহাব মিনার , সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি ব্যারিষ্টার ফুয়াদ, ব্যারিষ্টার জুবায়ের, যুবনেতা সাজ্জাদ, খালিদ হাসান, আনোয়র সাদাত টুটুল, আমিনুল ইসলাম, এস এম আব্দল রহমান, মারুফ , মামুন, নোমান, আমজাদ হোসেন  ও আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রমুখ।

দলে সংস্কার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে মা না চাওয়ায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুর রাজ্জাক জামায়াতে ইসলামী থকে পদত্যাগ করেন। তখন তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকার কথা বলেছিলেন। যদিও শুভাকাক্সী ও সমর্থকদের অনুরোধে তিনি মত পাল্টেছেন বলে জানা গেছে। ওই সময় রাজ্জাকের অবস্থানকে সমর্থন করে জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান। পরে তাকে সমন্বয়ক করে ‘জনআকাক্সার বাংলাদেশ’ গঠন করা হয়। এখন ঐতিহ্যবাহী ও প্রচীন এই দলটিকে ভাঙার ব্যাপারে সোলায়মান চৌধুরী কতটা সফল হয় সেটাই দেখার বিষয়। ধারণা করা হচ্ছে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই সে এই পদক্ষেপটি নিয়েছে। দলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তার অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। সব কিছুই স্বল্পতম সময়ের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে বলে ধারণা করা যায়। আ.লীগের যারা যতক্ষতিই করুক আ.লীগ তাদের পুরস্কত করে সোলায়মান চৌধুরি তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।

 লেখক উপদেষ্টা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সাবেক সংসদ সদস্য।





সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি