বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, 2০২4
আওয়ামী লীগকে আমলা লীগের দুর্নামমুক্ত হতে হবে
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Wednesday, 13 November, 2019 at 8:33 PM

ঢাকায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠানের তোড়জোড় চলছে। সবার চোখ এখন ঢাকার দিকে। আওয়ামী লীগ শুধু একাধিক্রমে তিন দফা ক্ষমতাসীন দল নয়, উপমহাদেশে ভারতের কংগ্রেসের মতো অন্যতম বৃহৎ জাতীয় সংগঠন। এ সংগঠনের ভালোমন্দের ওপর গোটা উপমহাদেশের ভালোমন্দ নির্ভর করে। ভারতের কংগ্রেস সম্পর্কে ব্রিটেনের একটি বাম সাপ্তাহিকে একবার মন্তব্য করা হয়েছিল- ‘এটা ভারতের জনগণের সৌভাগ্য যে, দেশটির স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালে মহাত্মা গান্ধী হিন্দুত্ববাদী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের বদলে সোশ্যাল ডেমোক্রেসিতে বিশ্বাসী জওয়াহের লাল নেহেরুকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন এবং নেহেরু ও নেহেরুকন্যা ইন্দিরা মিলে কয়েক দশক ধরে ভারত শাসন করেন। তা না হয়ে প্যাটেল প্রধানমন্ত্রী হলে ভারত আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তৈরি হওয়া দূরের কথা, এতদিনে বর্তমান মোদি আমলের চেয়েও কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত হতো, গোটা উপমহাদেশের জন্য তা হতো চরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।’
লন্ডনের এ সাপ্তাহিকটির মন্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করি। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে পরি, এটা বাংলাদেশের জনগণের সৌভাগ্য, স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু তার সংগঠনকে একটি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলে রূপান্তরিত করেছিলেন এবং দেশটিকেও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক দেশে পরিণত করার ভিত্তি তৈরি করে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত শক্তি দীর্ঘ একুশ বছর এই ভিত্তি ভাঙার চেষ্টা করেও পারেনি। বঙ্গবন্ধু এখন নেই। আওয়ামী লীগের আগের চরিত্রও পাল্টেছে। কিন্তু তার আদর্শিক রাজনীতির আগের শিকড় থেকে সে বিচ্যুত হতে পারেনি। এ শিকড়টা হল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি।
আওয়ামী লীগ যতই চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে থাকুক, তার বর্তমান সরকারের যতই ভালোমন্দ দিক থাকুক, বিলাতের কাগজটির মতো আমিও বিশ্বাস করি, বিএনপি ও জামায়াতের মতো একাত্তরের পরাজিত শক্তিগুলোকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করে দীর্ঘ তিন দফা আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় থাকতে না পারলে তা বাংলাদেশকে এতদিনে আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো কিলিং ফিল্ডে পরিণত করত।
মধ্যযুগীয় ফ্যাসিস্ট ধর্মীয় রাজ্যে রূপান্তরিত করত। সারা উপমহাদেশে তার প্রতিক্রিয়া ছড়াত। এটা যে হয়নি, তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনার নেতৃত্বের এবং আওয়ামী লীগের মতো বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠনের।
আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত, দলের আগের নিষ্ঠ ও ত্যাগী চরিত্র ফিরিয়ে আনার যথার্থ কার্যক্রম গ্রহণ। পুরনো আদর্শগুলোয় সম্পূর্ণ ফিরে যাওয়া এখন অসম্ভব। কারণ সময় বদলেছে, পৃথিবী বদলে গেছে। আওয়ামী লীগকেও মূল আদর্শের শিকড়ে যুক্ত থেকে চলমান জগতের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, আওয়ামী লীগকে তার সাংগঠনিক শক্তি অবশ্যই ফিরে পেতে হবে। হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন জনগণের তথা তার সংগঠনের শক্তির জোরে। তার ক্ষমতার এ ভিত্তিকে অবশ্যই আগলে রাখতে হবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বটে, কিন্তু তার সাংগঠনিক শক্তি একেবারে বিপর্যস্ত। কেউ কেউ এজন্য আওয়ামী লীগের এ সরকারকে ব্যঙ্গ করে বলেন আমলা লীগ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলা-নির্ভরতাও সংগঠনকে পাশ কাটিয়ে সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসির ওপর নির্ভর করে দেশ শাসন সব দেশেই সাময়িক সাফল্য আনে। এ সাফল্য শেষ পর্যন্ত দেশটির জন্য ভয়ংকর সর্বনাশ ডেকে আনে। আইয়ুব মিলিটারি শাসক ছিলেন। তবু তার সিভিল-মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি নির্ভর ডিকেড অব ডেভেলপমেন্ট বা উন্নয়নের দশক শুধু দেশের সর্বনাশ করেনি, তারও পতন ঘটিয়েছিল।
শুধু শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা ও ওবায়দুল কাদেরের কর্মতৎপরতা দ্বারা অর্থাৎ একক প্রচেষ্টায় আওয়ামী লীগের গণমুখী চরিত্র ফিরিয়ে আনা যাবে না। আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন বৃদ্ধ বটগাছের মতো। আগাছায় ভরে গেছে। এ আগাছা থেকে দলকে মুক্ত করে তাকে জনগণের সংগঠন এবং সরকারের শক্তির উৎস করে গড়ে তুলতে চাইলে দলের তৃণমূল পর্যন্ত শুদ্ধি অভিযান চালানো এবং নতুন রক্তের সঞ্চালন দরকার। দেখতে হবে এ নতুন রক্ত যেন দূষিত না হয়। কারণ ইদানীং দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের নতুন রক্তের উৎস যুবলীগ ও ছাত্রলীগেও এ দূষিত রক্ত ব্যাপকভাবে প্রবেশ করেছে।
প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ‘আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদে বড় পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। বর্তমান কমিটির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নেতা বাদ পড়তে পারেন। নিষ্ক্রিয়, বিতর্কিত নেতাদের বাদ দিয়ে তরুণ ও পরিছন্ন ভাবমূর্তির নেতাদের কমিটিতে স্থান দেয়া হবে।’
খবরটি খুবই আশাব্যঞ্জক। যদি এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় তাহলে আওয়ামী লীগ ভারতের কংগ্রেস দলের মতো পতন দশায় পড়বে না। পাকিস্তান আমলে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক সরকার যখন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন ওই সরকারের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। দলের অবস্থা ভালো ছিল না। সবকিছু দেখে দলের কেন্দ্রীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেছিলেন, ‘পার্টটাইম সভাপতি এবং পার্টটাইম সেক্রেটারি দিয়ে কোনো দল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে একজন পূর্ণ সময়ের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক দরকার। প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে কে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের হাল ধরতে রাজি আছেন?’ এই ডাকে তখনকার প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ সরকারের কোনো মন্ত্রী সাড়া দিতে রাজি হননি। রাজি হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন। তা শুধু দলে নতুন প্রাণসঞ্চার করেনি; একটি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামের শক্তি জুগিয়েছিল দলকে। অতীতের এ কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনাকে একবার অনুরোধ করেছিলাম, তিনি প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর পদে আছেন, থাকুন। আপনার থাকা প্রয়োজন। কিন্তু আপনি দলের সমর্থন নিয়ে শেখ রেহানাকে নির্বাহী সভানেত্রী করুন। শেখ হাসিনা রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শেখ রেহানা রাজি হননি।
বর্তমানেও শেখ হাসিনার ওপর প্রধানমন্ত্রী পদের যে গুরুদায়িত্ব রয়েছে, তাতে দলে একজন নির্বাহী সভাপতি অথবা সভানেত্রী প্রয়োজন; যিনি দলের জন্য পূর্ণ সময় দিতে পারবেন। এ পদ গ্রহণে শেখ রেহানা যদি এখন রাজি হন ভালো, নইলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে এই পদে বসানো যেতে পারে। দল পরিচালনায় তাতে তার অভিজ্ঞতা জন্মাবে, এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও। নইলে হাসিনার পর কে- এ প্রশ্নটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা সংশয় সৃষ্টি করবে।
দলের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় পরিবর্তন আনা হবে, তা ভালো। তবে সাধারণ সম্পাদক পদে ওবায়দুল কাদেরকে আরও কিছুকাল রাখা সম্ভবত সঙ্গত হবে। তার কারণ, হঠাৎ সাধারণ সম্পাদক পদে নতুন মুখ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে নাও পারেন। দল পরিচালনায় ওবায়দুল কাদেরের অভিজ্ঞতাকে আরও কিছুদিন কাজে লাগানো দরকর। তবে সাম্প্রতিককালে তার গুরুতর অসুস্থতার কথা ভেবে তার সঙ্গে দু’জন শক্তিশালী যুগ্ম সম্পাদক দেয়া যেতে পারে। এটা আমার ব্যক্তিগত সাজেশন। শেখ হাসিনা ও দলের নেতাকর্মীদের বিবেচনার জন্য লিখেছি। আগেই বলেছি, আওয়ামী লীগের এবারের জাতীয় সম্মেলনের ওপর শুধু বাংলাদেশের নয়, গোটা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আওয়ামী লীগের পুনর্গঠন ও শক্তি বৃদ্ধির অর্থ, বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির শক্তি বৃদ্ধি। তা উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতিরই শক্তি বৃদ্ধি করবে। আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলন সম্পর্কে আরও কিছু বলার কথা আছে। তা বারান্তরে লিখব।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি