মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, 2০২4
ক্রাইম অ্যান্ড পানিসমেন্ট
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Sunday, 28 July, 2019 at 9:41 PM

লন্ডনে বাঙালি শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে একদল রাগী লেখকের আবির্ভাব হয়েছে বেশকিছুকাল ধরে। এরা প্রচলিত সামাজিক রাজনৈতিক নিয়মকানুন সব তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে চান। এরা সাধারণত সোস্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করেন। এদের গায়ে কোনো দলীয় ছাপ মারা যায় না। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে এরা কখনো হাসিনা সরকারের এমন তীব্র সমালোচনা করেন যে, মনে হবে এরা বুঝি বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক। আবার যখন বিএনপি-জামায়াতের কঠোর নিন্দা করেন, তখন মনে হয় এরাই বুঝি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আসল অনুসারী।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সন্ত্রাসী, মাদকদ্রব্যের কালোবাজারি এবং সামাজিক দুস্কৃতীদের কেউ র্যাব বা পুলিশের সঙ্গে ক্রসফায়ারিংয়ে মারা গেলে এই রাগী লেখকগোষ্ঠী তাকে বলেন ‘বিচার বহির্ভূত অবৈধ হত্যাকাণ্ড’।’ এটা নিয়ে আমাদের সুশীল সমাজ যেমন সমালোচনায় উচ্চকণ্ঠ, তেমনি লন্ডনের বাঙালি তরুণ রাগী লেখকদের মূল অংশও অনুরূপ উচ্চকণ্ঠ।
বাংলাদেশের তরুণ রাগী লেখকদের, কলকাতায় ইংরেজ শাসনের সূচনায় ‘ডিজয়েইলির আমলে’ যাদের বলা হতো ‘এংরি ইয়ং’, তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই। তবে লন্ডনে বাস করি বলে এখানকার এংরি ইয়ংদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ আছে, তাদের কয়েকজন সম্প্রতি আমার বাসায় এসেছিলেন। দুই জন তরুণ এবং এক জন তরুণী। তারা এসেছিলেন, লন্ডনে সম্প্রতি নাইফ ক্রাইম (ছুরি মেরে হত্যা করার অপরাধ) যেভাবে বাড়ছে এবং তা বাংলাদেশি কম্যুনিটির তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যেও বাড়ছে, তা নিয়ে কিছু করা যায় কি না সে সম্পর্কে আলোচনা করতে। সম্প্রতি লন্ডনে পথেঘাটে টিউবে বাসে যেভাবে প্রত্যহ ছুরি মেরে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, তাকে এখন ব্রিটেনের এক নম্বর সমস্যা বলে বিবেচনা করা হচ্ছে।
দীর্ঘকাল ধরে এই নাইফ ক্রাইম চলছে। দিন দিন বাড়ছে। ব্রিটিশ পুলিশের মতো এত দক্ষ এবং মডার্ন পুলিশও এর কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। অপ্রাপ্তবয়স্কদের কাছে ছোরাছুরি বেচা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ছোরাছুরি বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাস্তাঘাটে পুলিশ পাহারা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনা হয়নি।
বাংলাদেশে সন্ত্রাসী, ব্লগার হত্যাকারী ও মাদক দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসায়ীদের দমনে বাংলাদেশের পুলিশ যে সাফল্য দেখিয়েছে, ব্রিটিশ পুলিশ নাইফ ক্রাইম দমনে সেই সাফল্যও দেখাতে পারছে না। ফলে সরকার বিব্রত। জনমনে আতঙ্ক ও তীব্র ক্ষোভ। ‘ব্রেক্সিট’ নিয়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং টোরি সরকারের নেতা পরিবর্তনের উত্তেজনার দিকে সকলের দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ থাকায় নাইফ ক্রাইম নিয়ে বড়ো ধরনের তোলপাড় শুরু হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা শেষ হলেই এই সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে বড়ো ধরনের সংকটের মোকাবিলা নতুন বরিস সরকারকে করতে হবে।
ব্রিটেনে নাইফ ক্রাইম ভয়াবহ মহামারির মতো দেখা দিলেও মিডিয়ায় একতরফা সরকারের ওপর দোষারোপ নেই। অপরাধ দমনে সরকারের ব্যর্থতার সমালোচনা করা হলেও এটাকে তারা একটা সামাজিক অপরাধের আকস্মিক বিস্ফোরণ হিসেবে দেখছে এবং তার সামাজিক সমাধানেরও বিভিন্ন সমাধান বাতলাচ্ছে। বাংলাদেশে অ্যাসিড মারা, ব্লগার হত্যার মতো এই নাইফ ক্রাইম দেখা দিলে আমাদের একশ্রেণির মিডিয়া ও সুশীল সমাজ একযোগে হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে জেহাদে নামতেন। লন্ডনের বাঙালি কয়েক জন এংরি লেখক আমাকে জানালেন, এই নাইফ ক্রাইম ব্রিটেনের অন্যান্য এথনিক মাইনরিটি কম্যুনিটির মতো বাংলাদেশি কমিউনিটির মধ্যেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। সকল সম্প্রদায়ের তরুণদের মতো বাংলাদেশিদের তরুণ প্রজন্মেই এই অপরাধ প্রবল। এই ছুরিকাঘাতের ঘটনার কোনো কোনোটার পেছনে বর্ণবিদ্বেষও রয়েছে, ইসলাম-ফোবিয়া রয়েছে। পারিবারিক বা সম্পত্তি ঘটিত স্বার্থদ্বন্দ্ব রয়েছে; কিন্তু অধিকাংশের পেছনে অবৈধ মাদকদ্রব্যের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর হাত রয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। অবৈধ মাদকদ্রব্যের ব্যবসা নিয়ে ব্রিটেনে অসংখ্য সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এরা এই ব্যবসা চালানোর জন্য (বাংলাদেশেও তাই হয়েছে) অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের অর্থ ও নানা প্রলোভন দেখিয়ে রিক্রুট করে। ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতা বা অন্যান্য স্বার্থদ্বন্দ্ব নিয়ে এই তরুণ-তরুণীদের মধ্যে বিবাদ দেখা দেয়। সিন্ডিকেটগুলোই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই বিবাদে জড়ায়। এই বিবাদে শোধ-প্রতিশোধের প্রতিযোগিতায় এক গ্রুপের তরুণেরা অন্য গ্রুপের তরুণদের নিধনের চেষ্টায় লিপ্ত হয়।
ইতালিতে এক সময় বড়ো বড়ো মাফিয়ারাও বিবাদে লিপ্ত হয়ে একে অন্যকে খুন করত। মাফিয়া গ্রুপের পালিত তরুণদের মধ্যে গোলাগুলি লেগেই ছিল। আইন ও পুলিশ কঠোর হওয়ায় ইতালির মাফিয়াদের দাপট এখন কমেছে, আমার কাছে যে তরুণেরা এসেছিলেন, তাদের এক জন বললেন, ব্রিটেনে এই নাইফ ক্রাইম কমাতে হলে আইন আরো কঠোর করতে হবে, তরুণদের জন্য সংস্কারমূলক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সেই সঙ্গে এই মাদক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটগুলোর সর্দারদের মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এরা সমাজের শত্রু, মানবতার শত্রু। আমি সুযোগ পেলাম, বললাম, বাংলাদেশে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অবৈধ মাদক ব্যবসা, নারীধর্ষণ এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর সিন্ডিকেটের নায়কদের শাস্তি কী হওয়া উচিত বলো? দলের মধ্যে যে তরুণী ছিলেন, তিনি বললেন, ‘মৃত্যুদণ্ড। এরা শুধু একজন মানুষকে নয়, মানবতাকে ধ্বংস করছে এবং সমাজকে ধ্বংস করছে, এদের বেঁচে থাকতে দেওয়া হলে সমাজ এবং মানবতা কারোরই রক্ষা নেই।’ এই তরুণীর বাড়ি বরগুনায়। পুলিশের গুলিতে নিহত নয়ন বন্ডকে তিনি চেনেন, বললেন, তার মৃত্যুতে আমি দুঃখিত নই, সে বেঁচে থাকলে বরগুনা ৩০ শতকের শিকাগোতে পরিণত হতো। আরেক তরুণ বললেন, তাকে বিচার করে ফাঁসি দেওয়া উচিত ছিল। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করি না। আমি তাকে বললাম, বিচার বহির্ভূত হত্যা আমিও সমর্থন করি না। কিন্তু আজকাল অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীকে শাস্তি দিতে বিচার ব্যবস্থা ব্যর্থ। আইনের নানা ফাঁকফোকরে, বিচার ব্যবস্থার নানা দুর্বলতায় তারা শাস্তি এড়ায়। বিচার শেষে খালাস পেয়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে। ব্রিটেনে এক সিরিয়াল কিলারকে সংশোধনাগারে সাত বছর রাখার পর চিকিত্সকেরা তাকে সম্পূর্ণ সুস্থ বলে অভিমত দিলে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তিলাভের পরের দিনই সে এক তরুণীকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। আরেক সিরিয়াল কিলার এবং রেপিস্ট ১০ বছর জেলে থেকে চিকিত্সালাভের পরও জেল থেকে বেরিয়েই আবার ধর্ষণ ও হত্যা শুরু করে। সে সরকারের কাছে আবেদন জানায় তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক। কারণ, অপরাধ প্রবণতা তার শরীরে এতো গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, তার ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার হাতে আর কোনো তরুণ-তরুণীর মৃত্যু ঘটুক, সে তা চায় না। অনেক অপরাধীর মনে অপরাধ প্রবণতা মজ্জাগত হয়ে গেলে তাদের যে আর সংশোধন করা যায় না, তার প্রমাণ বাংলাদেশেও রয়েছে। একাত্তরের ঘাতক ও দালালেরা মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করার পর বিনা বিচারে দেশে অবাধে বিচরণ করেছে ৪০ বছরের মতো। এত দীর্ঘ সময়েও তারা বিবেকের তাড়নায় অনুতপ্ত হয়নি। সংশোধিত হয়নি বরং দেশের রাজনীতিতে হত্যা, সন্ত্রাস, হাতকাটা, শির কাটার বর্বরতার প্রচলন করেছিলেন।
তাহলে বিশ্বে অপরাধ প্রবণতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে মৃত্যুদণ্ড কি আবার ফিরিয়ে আনা দরকার? এই প্রশ্নটি কোনো কোনো ব্রিটিশ-মিডিয়াই তুলেছে। আমি বাঙালি তরুণদের এই প্রশ্নটির জবাব দিতে পারিনি।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি