মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, 2০২4
মহাজোটের প্রয়োজন কি ফুরিয়ে গেছে?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Monday, 22 July, 2019 at 9:13 PM

সম্প্রতি কাদের সিদ্দিকীকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অবস্থা কী? তিনি জবাব দিয়েছেন, ‘ঐক্যফ্রন্ট তো খুঁজে পাই না।’ এটা হচ্ছে ঐক্যফ্রন্টের এক নেতার উক্তি। এরপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অবস্থা কী জানতে চাইলে এই মহাজোটের কোনো শরিক দল- যেমন ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন অথবা জাসদের ইনু কী জবাব দেবেন আমি তা এখন পর্যন্ত জানি না।
জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিও এখন পর্যন্ত মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত। আগের সংসদে তাদের দ্বৈত ভূমিকা ছিল। তারা মহাজোট সরকারে ছিলেন। আবার বিরোধী দল হিসেবেও সংসদে আসন গ্রহণ করেছেন। এবারের নির্বাচনের পর অন্যান্য শরিক দলের মতো জাতীয় পার্টিরও কোনো সদস্যকে মন্ত্রিসভায় নেয়া হয়নি। নির্বাচন করেছে মহাজোট। কিন্তু মন্ত্রিসভা গঠন করেছে এককভাবে আওয়ামী লীগ। সুতরাং বলা চলে এটা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা। এই অবস্থায় এরশাদ সাহেব বেঁচে থাকলে কী করতেন, তা বলা মুশকিল। তিনি আগের দ্বৈত ভূমিকা গ্রহণ করতেন, না মহাজোট ত্যাগ করে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকা নিতেন, তা এখন অনুমানের বিষয়। এরশাদবিহীন জাতীয় পার্টি নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব পরিহার করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতীয় রাজনীতিতে কোনো নির্দিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে কিনা তা দেখার রইল। এরশাদ সাহেবকে নিয়ে আমরা যতই সমালোচনা করি, তিনি আওয়ামী লীগের ‘বিপদের বন্ধু’ ছিলেন। আওয়ামী লীগের অত্যন্ত সংকটময় সময়ে তিনি বিএনপির আক্রোশ ও প্রলোভন দুই-ই অগ্রাহ্য করে মহাজোটে অবস্থান করেছেন। শেখ হাসিনার বিশেষ দূত হিসেবে কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও হাসিনা সরকারকে সহায়তা দেননি, তা নয়। গত সংসদে বিরোধী দলের প্রতীকী ভূমিকা নিয়ে সংসদকে বিরোধী দলশূন্য বলার প্রচারকে কিছুটা হলেও বন্ধ করেছেন।
আমার ধারণা, এরশাদ সাহেবের মৃত্যুতে বেশি ক্ষতি হল মহাজোটের। তিনি বেঁচে থেকে প্রকৃত বিরোধী দলের অবস্থান নিলেও তা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কল্যাণকর হতো। এরশাদ সাহেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে তার অভাবটা বোঝা যাবে না। বোঝা যাবে আরও কিছুদিন পর, যদি জাতীয় রাজনীতিতে ছোট-বড় কোনো সংকট দেখা দেয়। তার মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী দাঁড়ায়, এটা নির্ভর করে জিএম কাদের এবং বেগম রওশন এরশাদ ঐক্যবদ্ধ থেকে দলকে যৌথ নেতৃত্ব দিতে পারেন কিনা তার ওপর। নইলে দলটিকে ন্যাপ-ভাসানীর পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। মহাজোট ভেঙে দেয়া হয়নি। কিন্তু তা এখন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতো নিষ্ক্রিয়। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, তিনি জানেন না মহাজোটে তাদের অবস্থান কোথায়। জেপির আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেছেন, ‘আমরা ছাড়িনি, আমাদের ছাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।’ মহাজোটকে কোনো সম্মিলিত কর্মসূচির মাধ্যমে সক্রিয় রাখা হবে কিনা তা-ও এখন জোটের শরিকদের অজানা। জোটনেত্রী শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত জোটের সব শরিককে নিয়ে জোটের ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য কোনো বৈঠকে বসেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা দলীয় সরকার গঠনের পর মহাজোটের ভবিষ্যৎ নিয়ে কী ভাবছেন? তিনি জবাব দিলেন, মহাজোট থাকবে। যখন দরকার হবে আমরা সক্রিয় হব। সরকারে মহাজোটের শরিকদের নেয়া হয়নি। দরকার হলে নেয়া হবে। তিনি আরও বললেন, শরিক দলগুলোর নিজস্ব ভোট সামান্যই। তারা আওয়ামী লীগের ভোটে জেতেন। অনেকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জেতেন। সুতরাং আওয়ামী লীগ তাদের আপাতত মন্ত্রী করবে কী করবে না, সে সিদ্ধান্ত তো নিতেই পারে। আমি তার মন্তব্যে খুশি হইনি। মহাজোটের শরিক দলগুলোর যতটা নিজস্ব ভোট আছে, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা বড় বিবেচনা হতে পারে না। ১৯৫৪ সালে হক-ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সময় এমন দলকে গ্রহণ করা হয়েছিল, যার সাইনবোর্ড ছাড়া কোনো অস্তিত্ব ছিল না, ভোটের জন্য ওই দল বা দলগুলোকে গ্রহণ করা হয়নি। গ্রহণ করা হয়েছিল মুসলিম লীগের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে সারা দেশ ও জাতির সব অংশ যে ঐক্যবদ্ধ তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য। তাতে হক-ভাসানীর নেতৃত্বের ক্রেডিবিলিটি বেড়েছিল। বাংলাদেশে সামরিক শাসন, বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের দুঃশাসন অপসারণের জন্য এই ধরনের জাতীয় ঐক্য দরকার ছিল। আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক সংগ্রাম দ্বারা দুঃশাসনকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পেরেছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, নির্বাচনে পরাজয়ে দেশের সাম্প্রদায়িক ও উগ্র মৌলবাদী শক্তি সম্পূর্ণ উৎখাত হয়েছে। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অত বড় পরাজয়ের পরও ১৯৭৫ সালে তাদের রক্তাক্ত অভ্যুত্থান ঠেকানো যায়নি। বর্তমানে দেশে আওয়ামী লীগের পৌনঃপুনিক নির্বাচন জয়ের পর দেশের অশুভ শক্তি দুর্বল হয়েছে। তাদের দুর্গ ধ্বংস করা যায়নি। দেশের রাজনীতির দুই ভাগে পোলারাইজেশন হয়েছে। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তি, অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক, উগ্র মৌলবাদী শিবির। এই শিবির নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে; কিন্তু দেশের রাজনীতিতে এখনও শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে চূড়ান্ত জয়লাভের জন্য এখনও ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের ঐক্যবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। শত্রুর সম্মিলিত শক্তির ও অবিরাম চক্রান্তের মোকাবেলায় আওয়ামী লীগ একা হয়ে যেতে পারে না। মহাজোটের শরিক দলগুলোর অনেকের ভোট না থাকতে পারে; কিন্তু তাদের নেতাদের সুনাম আছে, জনগণের একাংশের মধ্যে হলেও যে জনপ্রিয়তা আছে, তা আওয়ামী লীগের বর্তমান অনেক নেতার নেই। বাংলাদেশে যতদিন গণতন্ত্রকে নিরাপদ করা না যায়, সেক্যুলারিজমকে স্থায়িত্ব দেয়া না যায়, ততদিন আওয়ামী লীগকে একলা চলার নীতি কিছুতেই অনুসরণ করা উচিত হবে না। ছোট ও বড় গণতান্ত্রিক দলগুলো নিয়ে গঠিত মহাজোটকে কিছুতেই নিষ্ক্রিয় করা বা দুর্বল করে ফেলা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘এক তারা যাহাদের, তারাও সম্মান যেন পায়।’ রাজনীতিতে যাদের তেমন ভোট নেই, কিন্তু যাদের প্রতি জনগণের অনেকের আস্থা ও সম্মান আছে, যারা গণতান্ত্রিক নীতিতে আস্থাবান, তাদেরও মহাজোটে সম্মান-মর্যাদা দিতে হবে। তাই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে নিষ্ক্রিয় বা অচল করে ফেলা উচিত হবে না, বরং গত নির্বাচন-পরবর্তী দেশের রাজনীতিতে মহাজোটকে নতুন কর্মকৌশল ও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। রাজনীতির মাঠে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সতর্ক অবস্থান নিতে হবে। আমার আরেকটি ধারণা, মন্ত্রিসভায় সব পুরনো মন্ত্রীকে বাদ দেয়া উচিত হয়নি। অবশ্য নতুন রক্ত সঞ্চালনের নীতি গ্রহণ করে শেখ হাসিনা ভালো করেছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে পুরনোদের অভিজ্ঞতাকে যুক্ত রাখা সমীচীন হতো। সব মন্ত্রীই নতুন এবং অনভিজ্ঞ হলে সেই সরকারে আমলাতন্ত্রের দাপট বাড়ে। বর্তমানে সেই দাপট প্রচণ্ডভাবে বেড়েছে। সবশেষে বলতে চাই, বিপদের দিনের সঙ্গীকে সুখের দিনে উপেক্ষা করতে নেই। তাতে ভবিষ্যতে বিপদ এলে সঙ্গী মিলবে না।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি