শিরোনাম: |
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কিছু কথা
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
আগামী বছর অর্থাৎ ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী সরকারি ও বেসরকারিভাবে সাড়ম্বরে উদযাপনের আয়োজন হয়েছে। এ উপলক্ষে ঢাকায় সরকারিভাবে যে আয়োজন হয়েছে, তাকে গ্র্যান্ড পিপারেশন বলা চলে। জাতির পিতার ওপর একাধিক গ্রন্থ প্রকাশ, কবিতা উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা ইত্যাদি বছরব্যাপী অনুষ্ঠিত হবে। সরকারি অনুষ্ঠানের অনুসরণে চলছে বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে এই জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন। একইসঙ্গে দেশে এবং বিদেশে বেসরকারিভাবেও এই বার্ষিকী উদযাপিত হবে।
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য হাসিনা সরকারের দুটি পদক্ষেপ উল্লেখযোগ্য। একটি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশ। এটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলেছে। বঙ্গবন্ধুর অনেক কঠোর সমালোচক, এমনকি শত্রুও এই আত্মজীবনী ও জেলের ডায়েরিটি পাঠ করে বলেছেন, তাদের বিভ্রান্তি দূর হয়েছে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপর পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম তৈরি করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে ভালো করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ৪৪ বছর পরও তার জীবনের বিশাল কর্মকাণ্ডের ওপর কোনো ছবি তৈরি হয়নি, এটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি করার অর্থ, তাকে বড় করা নয়। তার বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব তো শত্রুরাও গত ৪০ বছর ধরে অবিরাম চেষ্টা করেও খাটো করতে পারেনি। নিজেরাই ইতিহাসের আস্তাবলে নিক্ষিপ্ত হতে চলেছে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এক যুবনেতা সিলেটের বিয়ানীবাজারের আফসার খান সাদেক পূর্ব লন্ডনে তার সিডনি রোডের বাসার সামনে প্রশস্ত মাঠে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ প্রতিমূর্তি স্থাপন করেছেন। ২০১৬ সালে এই ভাস্কর্য স্থাপনের পর তাকে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতিদের চক্রান্তে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এক বছর মামলা লড়তে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মামলায় জয়ী হন। সিডনি রোডে এই ভাস্কর্যটি ২০১৬ সালে উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তারপর থেকে স্থানটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই ছবি করার অর্থ হবে গোটা বাংলাদেশের সভ্যতা-সংস্কৃতি, তার স্বাধীনতার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে নতুনভাবে তুলে ধরা। যা হবে গোটা জাতির জন্যই গর্ব ও গৌরবের নতুন প্রণোদনা। আমি জেনেছি, ছবিটি তৈরি হবে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনায়। অর্থাৎ দুই দেশের সরকারি কর্মকর্তাদেরই এই ছবিতে কর্তৃত্ব থাকবে বেশি। যদিও বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও অনুসারী বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এই ছবি নির্মাণের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, তথাপি আমার ভয় সরকারি কর্মকর্তারা যতই দক্ষ হন, তাদের ব্যবস্থাপনায় রাজনৈতিক নেতার জীবন নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ ও ছবি নির্মাণ তেমন সফল হয় না। বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে যাতে হাসিনা সরকারের উদ্যোগ সম্পর্কে আমার আশঙ্কা সত্য না হয়, সেই কামনা করি। ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক ছবি হয়েছে। সরকারের পরোক্ষ উদ্যোগে যেসব ছবি নির্মিত হয়েছে, তার একটিও দর্শকপ্রিয় বা সফল হয়নি। সফল হয়েছে এটেনবারা সাহেবের 'গান্ধী'। একজন সাদা বিদেশি তাতে গান্ধীর চরিত্রে অভিনয় করে সারাবিশ্বে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন। মহাত্মার জীবন নিয়ে নির্মিত এই ছবির অনেক সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা আছে। কিন্তু অন্যান্য ছবির চেয়ে এই বেসরকারিভাবে নির্মিত ছবিটিই শ্রেষ্ঠ। এটেনবারার গান্ধী ছবিকে টেক্কা দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার বিশাল অঙ্কের অর্থ ব্যয়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর জীবনের ওপর একটি ছবি নির্মাণ করেন। ছবির পরিচালক বিদেশি। জিন্নাহর চরিত্রেও অভিনয় করেন বিখ্যাত ব্রিটিশ অভিনেতা পিটার লি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, পাকিস্তানের কায়েদে আজমকে নিয়ে তৈরি এই ছবিতে নেহরু চরিত্রে বিস্ময়কর অভিনয় করেছেন আমাদের শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পুত্র সদ্যপ্রয়াত রাশেদ সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু ছবিটি ফ্লপ করে। পাকিস্তানের প্রেক্ষাগৃহে এই ছবি দেখার জন্য যেমন দর্শকদের ভিড় হয়নি, তেমনি বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে দর্শক হয়নি। আমি লন্ডনের একাডেমি সিনেমায় ছবিটি দেখতে গিয়েছিলাম। দর্শক ছিল হাতেগোনা কুড়িজন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পরিকল্পিত ছবিটির এই দশা হবে তা আমি বলি না। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণে ছবি তৈরি হলে কী হতে পারে তার একটি উদাহরণ দিলাম। এই উদাহরণ যেন বঙ্গবন্ধুর ছবির ব্যাপারে সত্য না হয় এটা আমারও প্রার্থনা। সরকারের পরিকল্পিত ছবিটি ভালো হোক আর মন্দ হোক বঙ্গবন্ধুর নামেই এই ছবিটি দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহে দর্শক উপচে পড়বে। যেমন শেখ হাসিনার ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র 'ডটারস টেল' দেখার জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোতে দর্শক উপচে পড়েছিল। কিন্তু আমি বলছি বিদেশের দর্শক টানার কথা। ছবিটি ইংরেজি ভাষায় তৈরি হবে বৈকি, কিন্তু আন্তর্জাতিক দর্শক টানতে পারবে কি-না, যেমন পেরেছে স্কটিশ হিরোকে নিয়ে তৈরি 'ব্রেভহার্ট' ছবিটি বা চে গুয়েভারাকে নিয়ে তৈরি ছবি। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রও তাদের মতো এতই নাটকীয় যে, তাকে নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের ছবি করতে পারলে বিশ্বের সকল এলাকার মানুষ তা দেখতে বিপুলভাবে আগ্রহী হবে। বঙ্গবন্ধু এখন জাতীয় নেতার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আন্তর্জাতিক নেতা হয়েছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ থেকে তাকে উপাধি দেওয়া হয়েছে বিশ্ববন্ধু। এই বিশ্ববন্ধু হিসেবেই তাকে ছায়াছবিতে ফুটিয়ে তোলা প্রয়োজন। যিনি এই ছবি করবেন তাকে শুধু নেতা বঙ্গবন্ধুর নয়, মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি চরিত্র-বৈশিষ্ট্য বুঝতে হবে এবং তাকে তার ছবিতে ফুটিয়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরিচালনায় যে ছবি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেই ছবির পরিচালক নির্বাচন করা হয় হয়েছে ভারতের স্যাম বেনেগালকে। ছায়াছবির পরিচালক হিসেবে তাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তিনি উঁচু মাপের পরিচালক। কিন্তু রাজনৈতিক চরিত্রের যথাযথ স্ম্ফুটনে তার নৈপুণ্য সম্পর্কে খুব একটা আস্থাশীল নই। তার পরিচালনায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে তৈরি 'A forgotten hero'বা 'একজন বিস্মৃত নেতা' ছবিটি আমি দেখেছি। এই ছবিতে সুভাষ বসু আছেন, তার চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নেই। তার দীর্ঘ এবং অতুলনীয় সংগ্রামী জীবনের চেয়ে তার বিতর্কিত বিবাহের বিষয়টি ছবিতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। স্যাম বেনেগালের ছবির সুভাষ বসু একজন নিরীহ পোষমানা বিদ্রোহী। সেই বিশ্ব কাঁপানো বিপ্লবী সংগ্রামী পুরুষ হিসেবে আমার চোখে ধরা পড়েনি। আসলে সুভাষ বসুর প্রকৃত চরিত্রটি স্যাম বেনেগাল ধরতে পারেননি। সুভাষ বসুর চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন তিনিও সম্যক ধরতে পারেননি। আমি প্রার্থনা করি বঙ্গবন্ধু ছবিতে পরিচালক স্যাম বেনেগাল এবং যিনি এই ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করবেন তিনিও যেন এই চরিত্রের বিশালতা ও অসাধারণ বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারেন এবং তাদের পরিচালনায় ও অভিনয়ে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। এবার আসি বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের কথায়। বিশ্বের সকল মহাপুরুষকেই জাতীয় জীবনে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। আতাতুর্ক, সাদ্দাম হোসেন, গাদ্দাফি প্রমুখ মুসলিম নেতাদেরও ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, বাংলাদেশে এই ভাস্কর্য সম্পর্কে গোঁড়ামি আছে। কিছুকাল আগে সুপ্রিম কোর্ট ভবনের সামনে স্থাপিত ভাস্কর্য নিয়ে চরম গোঁড়ামির প্রকাশ আমরা ঢাকায় দেখেছি। এখন সম্ভবত তা ভাঙতে বসেছে। গত এপ্রিল মাসে আমি ঢাকা গিয়েছিলাম। তখন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের কোনো কোনো রাস্তার মোড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য দেখেছি এবং আনন্দিত ও আশান্বিত হয়েছি। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে ঢাকার কোনো উপযুক্ত স্থানে তার একটি লাইফ সাইজ স্ট্যাচু নির্মাণের সিদ্ধান্তও সরকার নিয়েছে বলে জেনেছি। শুধু ঢাকা নয়, দেশের বড় বড় শহর এবং ব্যবসাকেন্দ্রেও এই ভাস্কর্য স্থাপন প্রয়োজন। লন্ডনেও একসময় মাদাম তুসোতে বঙ্গবন্ধুর স্ট্যাচু স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্যোগ আর এগোয়নি। লন্ডনের ক্যামডেনের বাঙালিরা সেখানে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও জামায়াতিদের বাধাদানের ফলে তা সফল হয়নি। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের এক যুবনেতা সিলেটের বিয়ানীবাজারের আফসার খান সাদেক পূর্ব লন্ডনে তার সিডনি রোডের বাসার সামনে প্রশস্ত মাঠে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে বঙ্গবন্ধুর একটি আবক্ষ প্রতিমূর্তি স্থাপন করেছেন। ২০১৬ সালে এই ভাস্কর্য স্থাপনের পর তাকে স্থানীয় বিএনপি-জামায়াতিদের চক্রান্তে নানা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। এক বছর মামলা লড়তে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত মামলায় জয়ী হন। সিডনি রোডে এই ভাস্কর্যটি ২০১৬ সালে উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তারপর থেকে স্থানটি তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। রোজ ছয় থেকে সাতশ' দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন এই ভাস্কর্য দেখতে এবং বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে। এখন সাদেকের ইচ্ছা, তার বাসাসংলগ্ন আর কয়েকটি বাসা কিনে নিয়ে স্থানটির 'Erlich cottage' (আরলিক কটেজ) নাম পাল্টে বঙ্গবন্ধু ভবন করা এবং সংলগ্ন রাস্তাটির নাম বঙ্গবন্ধু এভিনিউ রাখা। এ জন্য তিনি স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং বারা কাউন্সিলের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন চিকিৎসার জন্য ঘনঘন লন্ডনে আসছেন। তিনিও চান লন্ডনে একটি উপযুক্ত স্থানে নেলসন ম্যান্ডেলার মতো বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপিত হোক। তা যদি হয় পূর্ব লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি রক্ষার্থে আফসার খান সাদেকের প্রচেষ্টায় প্রধানমন্ত্রীর আরও উৎসাহদান প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কিংবা তার বোন শেখ রেহানা ভাস্কর্যটি পরিদর্শন করলে শুধু সাদেক নন আরও অনেক উৎসাহী প্রবাসী বাংলাদেশি জাতির জনকের স্মৃতি রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। বিশ্বজুড়ে বঙ্গবন্ধু চিরজাগ্রত থাকুন, এটা আমার প্রার্থনা। |