শুক্রবার, ২৯ মার্চ, 2০২4
একদিকে লোকসানের পাহাড়, অন্যদিকে বিনা টিকিটের যাত্রী
Published : Tuesday, 16 July, 2019 at 9:31 PM

স্টাফ রিপোর্টার॥
সড়কে তীব্র যানজট। কর্মদিবসে মতিঝিল থেকে উত্তরা যেতে ভিআইপি রোড দিয়ে যেতে সময় লাগে কমসেকম দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। তবে যাত্রা সময় অর্ধেক করে ফেলা সম্ভব। আর সেটা করেনও অনেকে। কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনে আসা-যাওয়া করে হাজার হাজার যাত্রী। সময় লাগে ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট। তবে এই হাজার হাজার যাত্রী সেবা নিলেও রেলওয়ে কিন্তু পাচ্ছে সামান্য অর্থ। তাদের মধ্যে সিংহভাগই টিকিট কাটেন না। টিকিট কাটতে বাধ্য করার মতো পরিস্থিতি যেমন নেই, তেমনি নেই সুযোগই। যাত্রীরা চাইলেও টিকিট কাটতে পারে না অবকাঠামোর অভাবে।
টিকিট ছাড়া হাজার হাজার যাত্রী, অথচ রেলের লোকসান বাড়ছে বছর বছর। তবু যাত্রীদের টিকিট কেনাতে বাধ্য করার দৃশ্যমান কোনো চেষ্টা নেই। নেই অবকাঠামো তৈরির উদ্যোগ। স্টেশনগুলো সব খোলামেলা, টিকিট না কেটেও ঢুকা যায়, বেরও হওয়া যায় অবলীলায়।
ঢাকা-বিমানবন্দর-গাজীপুর রুটে প্রতিদিন ৫৫টি ট্রেন যাতায়াত করে, যার মধ্যে ৩৪টি আন্তঃনগর ও ২১টি মেইল, ডেমু ও কমিউটার। এর প্রতিটিই থামে বিমানবন্দর স্টেশনে। আর কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন থাকে বলে অজস্র যাত্রী কমলাপুর আর বিমানবন্দর স্টেশনে অপেক্ষা করে।
এর মধ্যে কেবল ডেমু ও কমিউটার ট্রেনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আন্তঃনগরে এই স্বল্প দূরত্বে টিকিটের ব্যবস্থা থাকলেও কাটার সুব্যবস্থা নেই। যাত্রীরা দীর্ঘ পথের জন্য টিকিট কাটার লাইনে থাকে। আর স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা যে ট্রেন পায়, সেটাতেই ওঠে। ফলে আগে থেকে তারা টিকিট কেটে রাখে না। আর দীর্ঘ পথের যাত্রীদের লাইনে এই স্বল্প দূরত্বের যাত্রীরা টিকিট কাটতে পারে না বললেই চলে।
কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে গাজীপুর লাইনে লোকাল যাত্রীদের কাছ থেকে জুনে রেলওয়ে আয় হয়েছে ৪০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪০ হাজার তাৎক্ষণিক টিকিট বিক্রি করে ১৮ লাখ টাকা আয় হয়েছে। মাসিক কার্ড বিক্রি করে পাঁচ হাজার যাত্রীদের কাছ থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২২ লাখ টাকা।
যদিও কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত আয়ের আলাদা কোনো হিসাব নেই। তবে উল্টো পথের একটি হিসাব ধরলে আয়কে হাস্যকর মনে হবে। এক মাসে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আসা যাত্রীদের কাছ থেকে রেলওয়ের আয় হয়েছে মাত্র চার হাজার টাকা। অর্থাৎ বোঝা যায় সিংহভাগ যাত্রীই টিকিট কাটেন না। আরও স্পষ্ট যে, ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যে আয়, তাতে ঢাকা-বিমানবন্দর রুটের যাত্রীদের অবদান খুবই কম।
কমলপুরের স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হকের অবশ্য দাবি, এই পথে যাত্রীদের মধ্যে টিকিট কাটার প্রবণতা বেড়েছে। টিকিট কাটে না এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম।
তবে এই কর্মকর্তার দাবি আর বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর তফাৎ। বৃহস্পতিবার স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়া একটি ট্রেনে উঠে বিমানবন্দর স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে যে অভিজ্ঞতা পাওয়া গেছে, তা হলো এই দূরত্বের যাত্রীরা টিকিট কাটে কি কাটে না, তা নিয়ে রেলের ভাবান্তর নেই। যাত্রীরাও বিষয়টি গুরুত্ব দেয় না।
আর রেলের এই ঠকে যাওয়ার কারণ টিকিট করতে ব্যবস্থা না থাকা আর বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠার সুযোগ। উন্নত বিশ্বে এমনটি ভারতে নগরের ভেতরে চলা ট্রেনে টিকিট কাটা ছাড়া প্লাটফর্মে ঢুকার সুযোগ নেই। কিন্তু কমলাপুর বা বিমানবন্দর স্টেশন এমন সুরক্ষিত নয়। সেখানে অবাধে ঢুকা যায়, বেরও হওয়া যায়।
কেবল এই রুটে নয়, সারা দেশেই বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া যাত্রীর সংখ্যা কম নয়। নানা সময় বিভিন্ন জংশনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এর প্রমাণ মিলেছে। কেবল কিশোরগঞ্জের ভৈরব স্টেশনের চিত্রটি দিলেই পরিস্থিতিটা স্পষ্ট হবে।
গত ১৩ জুলাই এই স্টেশনে অভিযান চালিয়ে ৬৯০ জন যাত্রীকে জরিমানা করা হয় যারা টিকিট না কেটে ট্রেনে চড়েছিল।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর একই স্টেশনে বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠা ৭৫৮ জন যাত্রী ধরা পড়েন। তাদের কাছ থেকেও আদায় করা হয় জরিমানা।
২০১৮ সালের ২৮ এপ্রিল অভিযান চলে দিনভর। আর সে সময় বিনা টিকিটের যাত্রীও ধরা পড়ে বেশি। সেদিন জরিমানার মুখোমুখি হন এক হাজার ৮০ জন যাত্রী।
কমলাপুরের স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক বলছেন, ‘সামনে টিকিট এর নজরদারিতে আরও আধুনিক পদ্ধতি আনার পরিকল্পনা হচ্ছে।’
কমলাপুর-বিমানবন্দর স্টেশনের চিত্র
কমলাপুর থেকে বিমানবন্দর পথে প্রতিটি ট্রেনেই কিছু না কিছু আসন বরাদ্দ আছে। এই রুটে নিয়মিত যাত্রীরা মাসে ৪৫০ টাকা দিয়ে কার্ডও কিনতে পারেন। এই কার্ড দেখিয়ে যতবার খুশি ট্রেনে চড়া যায়।
নিত্য যানজটের এই শহরে কমলাপুর থেকে গাজীপুর বা ভৈরব পর্যন্ত দ্রুত গতির লোকাল ট্রেন চলছে যাত্রীদের দুর্ভোগ কিছুটা হলেও কমত। এটা স্বীকার করেন রেলের কর্মকর্তারাও। কিন্তু এ নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। গত ১০ বছরে ঢাকা-গাজীপুর রুটে কিছু ডেমু ট্রেন চালু হলেও এর বেশ কিছু এরই মধ্যে বসে আছে। তবে কিছু লোকাল ট্রেন এই রুটে চলে, কয়েকটি কমিউটারও যায়। আয় হয় মূলত এ থেকেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা
বলেন, ‘প্রতি মাসে এই আয় হতে পারত কয়েক কোটি টাকা। এ জন্য আলাদা লোকবল ও সুনির্দিষ্ট কাউন্টার থাকলে এটি সম্ভব হতো।’
‘অফিস শেষ করে চাকরিজীবীদের দাঁড়াতে হয় দূরপাল্লার যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে পেছনে, সে কারণেও ইচ্ছে থাকলেও টিকিক কাটতে পারেন না অনেক যাত্রীরা। তাদের জন্য আলাদা কাউন্টার বরাদ্দ থাকলে এই পথে আয় বাড়ত বহুগুণ।’
বিভিন্ন দেশে টিকিট কাটতে আলাদা বুথ থাকে। সেখানে নির্ধারিত টাকা বা পয়সা ফেললেই টিকিট বের হয়ে আসে। এই ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলেও মনে করেন এই কর্মকর্তা।
টিকিট না কাটায় রেলের ক্ষতি হলেও পোয়াবারো ট্রেনের কিছু কর্মচারী আর নিরাপত্তা কর্মীর। তারা যাত্রীদের কাছ থেকে ৫-১০ টাকা করে তোলে নিজেদের পকেটে পুরেন, এরপর ভাগাভাগি করেন।
আবার কমলাপুরের পথে বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যাওয়া যাত্রীদের টিকিটও বিমানবন্দর থেকে কমলাপুরের দিকে আসা যাত্রীদের কাছে ৫-১০ টাকায় বিক্রি করেন।
আবার বিনা টিকিটের যাত্রীদের স্টেশনের আগে নামিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিও আছে। এ জন্য খিলগাঁও রেল গেটে ট্রেন চলে অত্যন্ত ধীর গতিতে। তখন লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যায় বিনা টিকিটের যাত্রীরা।’
রেলের একজন কর্মকর্তা নিজেই বললেন, এটা সারা দেশেই হয়। কিন্তু ঠেকানোর কোনো উপায় তিনি নিজেও জানেন না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক মনে করেন, যাত্রীদের টিকিট কাটতে বাধ্য না করার পেছনে রেলের কর্মীদের স্বার্থ জড়িত।
তিনি বলেন, ‘টিকিট কেটে রেলে চড়ার চেয়ে চেকারদের নগদ পয়সা দিয়ে চলা লাভজনক। টিটিরাও এটাকেই উৎসাহিত করে। অর্থাৎ চুরির ক্ষেত্রে দুপক্ষই উৎসাহী। রেলওয়েতে এই চক্র নিচ থেকে ওপর পর্যন্ত বলেই আমরা মনে করি।’
লোকসান পাহাড় সমান
টিকিট না কেটে ট্রেনে চড়ার এই প্রবণতার মধ্যে ট্রেনের লোকসান বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে।
২০০৯-১০ অর্থবছরে রেলওয়ের লোকসান ছিল ৭৫৮ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে তা প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে হয় ১০০৮ কোটি টাকা। পরের বছর আবার ৫০ শতাংশ বেড়ে হয় এক হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
ভাড়া বাড়ানোর পর ২০১২-১৩ অর্থবছরে লোকসান হয় ৮৮১ কোটি টাকা। পরের বছর তা কিছুটা কমে হয় ৮০৩ কোটি টাকা। এরপর আবার বাড়তে থাকে লোকসান। ২০১৪-১৫ সালে সরকারের ক্ষতি হয় ৯০০ কোটি টাকা। পরের বছর তা আরও বেড়ে হয় এক হাজার ৩০৩ কোটি টাকা।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে লোকসান বেড়ে হয় এক হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা। পরের বছর তা কিছুটা কমে দাঁড়ায় এক হাজার ছয়শ কোটি টাকা।



সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি