শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, 2০২3
হাজারীর আত্মজীবনী (পর্ব-১১৯)
Published : Saturday, 20 May, 2017 at 4:49 PM, Update: 31.03.2019 9:55:57 PM

শোক দিবসের ভাষণ
সংগ্রামী ভায়েরা, আমার ছালাম নেবেন,
আমি রবি ঠাকুরকে দেখিনি তার পদধূলি নেওয়ার সুযোগও পাইনি, কারণ আমার জন্মের আগেই তিনি পরলোক গমন করেন, তবে আক্ষেপ নেই। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবকে দেখেছি, আলিঙ্গনও করেছি। অবশ্য যারা তাঁকে সপরিবারে খুন করেছে, তারা যদি বেঁচে থাকে তাহলে আমাদের মরে যাওয়াই ভালো। বর্তমান সরকার কি করতে চায় ঠিক বুঝতে পারি না, আসলে নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা ছাড়বে কিনা সেটাও পরিষ্কার নয়। তবে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিক। এটাও বুঝি যে, এই কাজটি সেনাপ্রধানের ইচ্ছানুযায়ী হয়েছে। তাই তাকে বলি এই সুযোগে, ইতিহাসে নিজের নামটি যুক্ত করে ফেলুন, খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করুন। যে কাজটি রাখাল রাজার কন্যা করতে পারেনি সেই কাজটি যদি আপনি করতে পারেন, রাখাল রাজার নামের পাশে আপনার নামটিও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আগামীকাল ১৬ আগস্ট আমার প্রবাস জীবনের সাত বছর পূর্ণ হবে, এই দীর্ঘ সময় ধরে এলাকার বাইরে থাকব এমনটি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। যখন জেলে ছিলাম বা দু-একবার বিদেশে ছিলাম, তখনকার কথা বাদ দিলে। এলাকার বাইরে ছিলাম কিনা সন্দেহ। মুজিব উদ্যানে মর্নিংওয়াক আর বিকেলে ব্যাডমিল্টন না খেলতে পারলে রাতে ঘুমই আসত না। কর্মহীন অনিশ্চিত প্রবাস জীবন ভীষণ যন্ত্রনাদায়ক। যাযাবরের ভাষায় এটাকে ‘দীপ্তিহীন অগ্নির নির্দয় দহন’ বলা যেতে পারে। তবু মানসিক শক্তির জোরে সবকিছুকে মানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু আজকের বঙ্গবন্ধুর এই মৃত্যুদিনে নিজের পরিমণ্ডলে ফিরে যাবার জন্য মন বড় ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর নয়, এবার ফিরে যাবই! বড় বড় উকিলরা বলেছেন হয়তো কিছুদিন জেলে থাকলে হতে পারে, আর কিচ্ছু না। নেতারা বলেছেন ইউরোপীয় কোনো দেশের দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় নাও, তাদের মাধ্যমে ফিরলে ঝুঁকি কম হবে। আনোয়ার ইকবাল খবর দিয়েছে- সরকারের দিক থেকে কিছু করা হবে না। আদালতে যে রায় দেবে সেই মতোই কাজ হবে, ইকবাল ছাত্রজীবনে আমার খুব ভক্ত ছিল, কিন্তু সে কি পারবে আইনের পথে চলতে?
২০০১ সালের ১৭ আগস্ট সকালবেলা ২০০০ সদস্যের যৌথবাহিনী আমার বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল, আমাকে ধরতে নয়, খুন করতে। তার প্রমাণ হচ্ছে, যেখানে কোনো প্রকার প্রতিরোধ হয়নি সেই এলাকায় অকারণে পাঁচদিন কারফিউ জারি করে রাখা, ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে আমাকে সরে যেতে হয়েছে। ডিসি সোলায়মান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, হাজারীকে দেখামাত্র গুলি করা হবে। এসব জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় লিপিবদ্ধ আছে।
ওদের অভিযানটি ব্যর্থ হয়েছিল। কারণ ওরা ধরতেও পারেনি, মারতেও পারেনি। সকাল নয়টায় বিচারপতি লতিফুর রহমানের প্রশ্ন ‘কি করে গেল? কোথায় গেল? ভোটের সময় এই লতিফুর রহমান ডিসি সোলায়মানকে বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে ক্ষতি নেই। কিন্তু হাজারী জিতে গেলে তাকে আত্মহত্যা করতে হবে। এই বিচারপতি তার আত্মকথায় চার জায়গায় আমার নাম উল্লেখ করেছেন, এখন ডিসি সোলায়মান ঢাকা শহরে পালিয়ে বেড়ান। রাতে বাড়ি বদল করে ঘুমান। অভিযানের পর আত্মগোপনে গেলেও দল আমাকেই নমিনেশন দেয়। এই সময় আমকে ধরার জন্য নেত্রীর গাড়িতে পর্যন্ত তল্লাশি কর হয়। কোনো কেন্দ্রে এজেন্ট বসতে দেওয়া হয়নি, কোথাও নৌকার প্রতীক লাগাতে দেওয়া হয়নি। স্টিয়ারি বলে কর্মীদের উপর যে বর্বরতা নির্যাতন হয়েছে তার কোনো নজির নেই। বিভিন্ন বাহিনীর লোকেরা আমার লোকদের জিপের পেছনে বেঁধে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়েছে। তবু অন্যবারের তুলনায় বেশি ভোট পেয়েছিলাম। আগে তিনবার জিতলেও এবারের মতো কোনো বার ৮০ হাজার ভোট পাইনি। সর্বশক্তি দিয়ে হাইকোর্টে ঢোকার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পুলিশ হাইকোর্ট ঘেরাও করে রাখেনি, আমাকে খুঁজতে গিয়ে অনেক বিচারপতিকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেহ পর্যন্ত তল্লাশি করেছে। সকল মহিলাদের বোকরা খুলে তল্লাশি করেছে। এগুলো সবই জাতীয় পত্রিকাগুলোতে লিপিবদ্ধ আছে। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে পত্রিকায় বিকৃতি দিয়ে বলেছিলাম, জেলে থাকতে চাই, ফাঁসি হলে হাসিমুখে বরণ করে নেওয়ার কথাও বলেছিলাম। কিন্তু অপমৃত্যু হবে না এমন আশ্বাস কেউ দিতে পারল না। এমন কি বর্তমান সরকারও না। এভাবে সাতটি বছর কেটে গেল।
মুসলিম হিসেবে বিশ্বাস করি ‘হায়াত মওত আল্লাহর হাতে’, অন্যদিকে জানি জীবন বাঁচাতে আমাদের নবী করিম (সাঃ)ও মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেছিলেন, দীর্ঘ সাত বছরের যন্ত্রণাভরা জীবনে অনেক হারানোর বেদনাতো আছেই, তার মধ্যে কিছু অর্জনও আছে, এই সময় আমি একটি আত্মজীবনী রচনা করেছি, এতে ভালো-মন্দ যা করেছি সবই যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে তুলে ধরেছি। আমার অঙ্গে যত কালিমা লেপন করা হয়েছে আশা করি, এই বইয়ের কারণে তার অনেকটাই ধুয়ে মুছে যাবে। যে ডিগ্রি কলেজটি থেকে আমার নামটি বাদ দেওয়া হয়েছিল দেশের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সেই কলেজটি আমার নামেই থাকবে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের কারণে আর কোনো সরকারই এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নাম পরিবর্তন করতে পারবে না।
চরম হতাশ কাকে বলে আসলে জানি না। তবে হতাশ মনের অভিব্যক্তি কিনা বুঝি না। কেন জানি বার বার মনে হচ্ছে সুদূরের ডাক এসেছে। চলে যেতে হবে, চলে গেলে যেন জন্মভিটেয় চিরনিদ্রায় থাকতে পারি সে প্রত্যাশাই মনকে ব্যাকুল করে, কি কঠিন বাস্তবতা জানি না, মরণের কথা ভেবে সামান্যতম দুঃখবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে না, বরং আমার মধ্যে একপ্রকার প্রচ্ছন্ন আনন্দানুভূতি কাজ করে। কারণ আমার বিশ্বাস মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আইনগত মরদেহটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের মরাদেহ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের বিধানটি করার জন্য অনন্তকাল শেখ হাসিনার পায়ে মাথা ঠেকালেও ঋণ শোধ হবে না, আইনের প্রতি আমার অবিচল আস্থা আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, কিছুই পেলাম না। আমি বলি সবই তো পেয়েছি। স্বাধীনতার জন্য যখন যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি, তাহলে পাওয়ার আর কি বাকি থাকে? দলের মধ্যেও দেখি অনেকে বলেন, দল করে কি পেলাম, তাদের কথা জানি না , আমি তো তিনবারের সর্বোচ্চ আইনসভায় সদস্য হয়েছি আর কিছু চাই না। তিনবারই শেখ হাসিনার কালে দল থেকে নমিনেশন পেয়েছি। শেখ হাসিনার পিতার হাত ধরেই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলাম। দুঃখ একটাই, সেই শেখ হাসিনাই কুচক্রীদের কথায় প্রভাবিত হয়ে সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগেরে ভিক্তিতে আমাকে দল থেকে বহিস্কার করার সম্মতি দিতে বাধ্য হন।
দল করার কারণে বিশ বছর ঘরেই ঢুকতে পারিনি। দশ বছর কারাগারে ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ঢাকা সেনানিবাসের অন্ধকূপে একমাস দশ দিন থাকতে হয়েছিল। এরশাদ আমলে চরম এক বিপদ মুহূর্তে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শেখ হাসিনা আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেখানেও এরশাদের বাহিনী হামলা চালায়। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনা ছুটে এসেছিলেন। এ রকম আর এক বিপদের মেয়র মহিউদ্দিনও আমাকে একটি গোপন জায়গায় আশ্রয় দিয়ে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। মানুষের ভুল তো হবেই। নিশ্চয়ই আমার ও ভুল ছিল, ভুলের জন্য যদি শাস্তি হতো মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগের ভিক্তিতে দল থেকে বহিস্কারের ঘটনাটি কেবল দুঃখ দেয়। সু-সময় যখন অনেক উল্টো-পাল্টা করেছি তখন কেউ কিছু বলেনি, খালেদা জিয়া যখন নিজের প্রভাবে বলয়কে শক্ত করতে গিয়ে আমাকে চরম বিপদের মুখে ঠেলে দিতে সফল হলেন ঠিক তখনই দলের থেকেও আঘাত এলো এটাই ক্ষতিকর। যখন দল পাশে দাঁড়ানোর কথা তখন উল্টে আরও বিপদ এনে দিল। তখন তো সান্ত্বনা পাওয়ার জায়গা থাকে না। সে জন্য মাঝে মধ্যে ভাবি এই দুঃখটা শুধু সারাজীবন নয়, মৃত্যুর পরও বইতে হবে। বলা হল পৌর নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছি, অথচ প্রার্থী নিজের কেন্দ্রে ২% ভোটও পায়নি। আমার বাড়ির চারপাশের কেন্দ্রগুলোতে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পেয়েছে। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। তিনি ফেনী থেকে তিনবার এমপিও হয়েছেন। নিজেকে ফেনীর মেয়ে বলে দাবি করেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রীর প্রার্থীকে এলাকার বাইরে থেকে আমি কি করে হারাব? ফেনীর বেশ কয়েকজন রথী-মহারথী শেখ হাসিনার চারপাশে ঘোরেন। তাদের একজনও ভোটের সময় এলাকায় এলেন না, তাদের কোনো দোষ হলো না, দোষ হলো আমার। এর আগে জলিল ভাইয়ের মিটিং-এ গোলযোগ করার অভিযোগ তুলে তল্লাশি জন নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিস্কার করা হয়। তাদের অনেকেই ওই মিটিং-এই ছিল না, ইসমাইল, হাবিব, সুখদেব, বেলাল, মিজান, ও বদির চেয়ারম্যানের মাথায় এখনো বহিস্কারের খড়গ ঝুলছে। সিন্দুরপুরের এক ব্যবসায়ীকে আমার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য নেত্রীর এপিএস, তার অগোচারে আগাগোড়াই এসব ষড়যন্ত্র করে আসছিল। সেই এপিএস এখন কি পিএস জানি না। তবে পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজের পড়ার সম্ভাবনা থাকে। দেশ গড়ার সংগ্রামে যারা আমার সাথে ছিল তাদের সঙ্গে সামান্যতমও বিভেদ ছিল না। যার ফলে কেউ কোনোদিন কোনো কিছুতেই আমাকে হারাতে পারেনি। সত্য স্বীকার না করে কোনো লাভ নেই, আজ আর সেই সুদৃঢ় ঐক্যের বন্ধন আমাদের গ্রামগুলোতে নেই। শুধুমাত্র প্রলোভনে পড়ে দু-একজন পঞ্চাশ বছরের ঐক্যে নষ্ট করার প্রয়াস পাচ্ছে। আজ জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সকলের প্রতি আবেদন থাকবে- সকলে আবার এক পতাকার তলে সমাবেত হন, এটি আমার নয় আপনাদের কাজে লাগবে, আপনারা এক থাকলে আমাকে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না, আমার দোষ থাকলে আমার উপর ক্ষোভ থাকলে আমাকে যত ইচ্ছা গালাগাল করুন। আমি তো এমনিতেই বাদ। আমাকে নিয়ে তো ভাবনার কিছু নেই। সারাটি জীবন যে একতার পথ দেখিয়েছি সেটি দেখে যেতে পারলেই সান্ত্বনা পাবো। মানুষ হিসাবে ভুলতো আমার নিশ্চয়ই হয়েছে, সেই ভুলের জন্য আমার গ্রামবাসী, ১৫ লক্ষ ফেনীবাসী ও দেশবাসী সকলের কাছে মাফ চাই।
সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ দু-একটি কথা বলে যেতে চাই, মেনে নিলাম অনেক কিছু খারাপ করেছি, তবে পুলিশ রিক্সওয়ালা সাহাবুদ্দিনকে মেরে বরইয়া টিলায় পুতে ফেলেছিল, পুলিশের সঙ্গে লড়াই করে সেই লাশ শহীদ মিনারে তার মায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। ডিসি অফিসের পশ্চিম থেকে হাইরোড পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি একরাতেই করে দিয়েছিলাম, এরশাদ, খালেদা চেষ্টা করেও কাজটি করতে পারেনি। শহীদ সালামের নামে তার নিজের গ্রামের নাম ও ফেনী স্টেডিয়ামের নামকরণ করেছিলাম। মুক্তবাজার ও মৌলভীবাজার প্রতিষ্ঠা করেছি। ডাক্তারদের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও ডায়বেটিক হাসপাতাল চালু করে দিয়েছি। হাজারী কলেজকে এক বছর প্রথম শ্রেণীর কলেজে উন্নীত করেছি, এসব কি কেবলই খারাপ করেছিলাম, খারাপ যদি কিছু করে থাকি নিশ্চয় সবাই সেগুলো বেশি করে বলুন। তাই বলে যা কিছু সুন্দর চিরকল্যাণকর বা সমাজ মঙ্গলের জন্য করেছি সেগুলো একবারও বলবেন না? সহদেবপুর থেকে মোটবী ইউনিয়নের শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন সেতুসহ রাস্তাটি কে করেছিল? জাতীয় পার্টি ও বিএনপি ব্যর্থ হবার পর ডাক্তার পাড়ার মাথায় থাকা বৃটিশ আমলের লাশ ঘরটি কে সরিয়েছিল? ডিসি অফিসের সামনে থেকে সুইপার কলোনি সরিয়ে ওসমানী স্কুলের পরিবেশ সুন্দর ও জায়গা প্রশস্ত করেছিল কে? এইসব ভুলে যাওয়া কি উচিত হবে? আমি তো জেল রোড, কলেজ রোড ও স্টেশন রোডে অনেক স্থাপনা তৈরি করেছিলাম। সলেমান সব ভেঙে দিয়েছিল, গরিবের পেটে লাথি মেরেছিল, লাভ তো কিছু হয়নি। টাইগার বাহিনীর হামলা থেকে ব্যবসায়ীদেরকে রক্ষা করেছিল কে? সারাদেশে বিধবারা ভাতা পেত ১০০ টাকা। পুরো ফেনী জেলায় আমি দিয়েছি ২০০ টাকা করে, ইংরেজি ও কম্পিউটার প্রসারের যে উদ্যোগ নিয়েছিলাম তাতে ফেনী এতদিনে বাংলার ব্যাঙ্গালোরে পরিণত হতো। আমার মনে হয়, ইতিহাস থেকে সব কিছু মুছে ফেলা যাবে না, নিশ্চয় আপনাদের অনেকের স্মরণ থাকবে উম্মেহানি নামের একটি মেয়ের শ্লীলতাহানীর কল্পকাহিনী দিয়ে দৈনিক কনকণ্ঠ ছয় মাস ধরে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছে, বিধির কি বিচিত্র বিধান মাহমুদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেই জনকন্ঠ যখন অর্থের অভাবে বিলীন হওয়ার পথে, তখন তারা আমার সহযোগিতা চাইলেন, কাগজ কেনার জন্য টাকা নেই, কাগজ কিনে দিলাম। মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্রটি মুখ থুবড়ে পড়বে মানতে পারলাম না। ওদের বলেছিলাম, এখন আমার আগের অবস্থা নেই, থাকলে টেলিফোনেই এরূপ কয়েকটি জনকণ্ঠ চালানোর ব্যবস্থা করতে পারতাম। তবে এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। কেউ কথা শুনবে না এমনও তো নয়, তাই বলেছিলাম যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, প্রাণপণে সংগ্রামে চালাবো। কারণ মাসুদসহ চাকুলিয়ায় তিন মাস একই ক্যাম্পে থেকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য, সিএনজি স্পেশাল ট্রেনিং নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভুলে গেলেও জনকণ্ঠ ভোলেনি। তাই কিছু লোক আমাকে নিয়েই আবার বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে।
তারপর প্রথম আলোর ভূমিকা সকলের জানা, সংসদে বলেছিলাম, মুসলমান ঘরের বিবাহিত মেয়ে স্বামীর বন্ধুর হাত ধরে রমজান মাসের রাত তিনটায় ঘরের বাইরে রাস্তায় মত্ত ছেলেদের সঙ্গে নাচতে যেতে পারে না। একথা বলতে নাকি সংসদ কলঙ্কিত হয়েছে। এক সপ্তাহের ভেতরে এ ব্যাপারে দুটি সম্পাদকীয় লিখেছে। গাফফর চৌধুরীর একটি লেখায় এ প্রসঙ্গে কিছু কথা আমার পক্ষে যাওয়ায় তারা সে লেখাটি ছাপেনি। এহেন প্রথম আলো বহিস্কারের পর একটি অনলাইন জরিপ করেছিল সে জরিপের রায় আমার পক্ষেই গিয়েছিল। অবিশ্বাস্যভাবে প্রথম আলো এই ফলাফলের রায়টি তাদের কাগজেই ছাপিয়ে দেয়। শুধু তাই নয় যখন এলাকাতেই নেই, দেশে নেই, রাজনীতিতে নেই, কোনো কিছুতে নেই তখনও অন্তহীন অপপ্রচার দুরন্ত গতিতে চলছে। অনেকেই বিরক্ত হবেন জানি, তবু এগুলো নিয়ে কিছু কথা বলতেই হবে। ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার পরদিন যুগন্তরসহ কয়েকটি কাগজ লিখেছে- এই ঘটনায় হাজারী জড়িত, আসলে কারা জড়িত সকলেই জানে, ওরা ধরা পড়েছে। ওদের প্রায় সকলের শাস্তিও হয়েছে। ২০০৪ সালে জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছাপা হলো তসলিমার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে, তসলিমা নিজেই এর প্রতিবাদ করেছে, ২০০৭ সালের ২৯ আগস্ট ইত্তেফাকের মতো নির্ভরশীল পত্রিকা হেড লাইন দিয়ে খবর ছাপিয়ে বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আন্দোলনের সময় সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে দিতে জয়নাল হাজারীর ইন্ধন ছিল। একই খবরে বলা হয়েছিল, শেখ হাসিনাকে মুক্ত করতে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পতন ঘটাতে শুধু দেশের অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি নয়, বরং সাংসদ সেলিম ও ভারতের বিদেশ মন্ত্রী প্রণব মুখার্জীকে নিয়ে সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছি। এই মর্মে তার আগে দৈনিক নয়াদিগন্ত গোয়েন্দা সংস্থার বরাদ দিয়ে গুরুত্বসহকারে প্রথম পাতায় ছাপিয়েছে, ২৯ আগস্ট আমাদের সময়ও প্রথম পাতায় খবরটি ছাপিয়েছে হাজারীর সঙ্গে সোনিয়ার কোনো সাক্ষাত হয়নি, কিছুদিন পর এই প্রসঙ্গ টেনে আনন্দবাজার সচিত্র প্রতিবেদন ছাপিয়ে এবং আমি সেনাপ্রধানকে খোলা চিঠি দিয়ে বলেছিলাম, জরুরি প্রয়োজনে এবং মহাবিপদের সময় কেবল ভারতই আমাদের সাহায্য করতে পারে। কিন্তু অকারণেই সেই দেশের সরকার ও নেত্রীকে হেয় করলে তা আমাদের ক্ষতির কারণ হতে পারে। ভবিষ্যতে যাতে এরূপ প্ররোচনা না হয় সেই পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছিলাম,ওই প্ররোচনায় আমার কোনো ক্ষতি হয়নি কারণ ওই পত্রিকাগুলো দেখালে যেকোনো আদালত বা সরকার আমাকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে শুধু রাজনৈতিক আশ্রয় নয়, নাগরিকত্ব দিতেও এগিয়ে আসবে। এসব মিথ্যা রটনা নিশ্চয়ই দুর্ভাগ্যজনক। কিন্তু তার চেয়েও বেদনাদায়ক হলো এসবের প্রতিবাদ বা সংশোধনী দিলেও কেউ তা ছাপে না। গত এক বছর ধরে কেউ একটি লাইনও ছাপেনি। তবে আমার বিরুদ্ধে গেলে ছাপে, পক্ষে হলে নয়। শুধু এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে নিজের কথা মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য কয়েকটি ওয়েভসাইট খুলেছি। কোনো উপায় না দেখে নিজেই নিজের কথা বলার জন্য তথ্য প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েছি। এটি আপাতত ট্যাঙ্কের সঙ্গে গ্রেনেড দিয়ে লড়াই করার মতো ঠিকই তবে বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্য প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার সময় একটি ওয়েভসাইট কয়েকটি ট্যাঙ্কের শক্তি অর্জন করতে পারে। এ বছরের স্বাধীনতা দিবসে এর যাত্রা শুরু হয়েছে। আর শোক দিবসে এটি চলতে শুরু করবে, হাজারী ডট কম থেকে খবর ও মতামত পরিবেশিত হবে। মাস্টারপাড়া ডট কম থেকে ধারাবাহিকভাবে আমার আত্মকথাটি প্রকাশিত হবে ১ লা সেপ্টম্বর থেকে তিন মাস পর্যন্ত। শোক দিবসের দিনে সবকটি সাইট থেকে আমার ভাষণটি ছাপা হবে আর কথা বাড়াতে চাই না। এবার প্রবাস জীবনের অবসান ঘটাতে চাই। আর কোনো বাধা মানব না, কারও কথা শুনব না, এ বছরের বিজয় দিবসের আগেই সেই পুরানো চিরচেনা পরিবেশে ফিরে যাব, মরণে আর ভয়ও নাই, আমি কিছু কথা বেশি বলে নিলাম কারণ হয়তো আর সুযোগ পাব না। কেউ কেউ বলেন, আমি নাকি নারীবিদ্বেষী। এটা কি করে সম্ভব। আমি তো এক মহিয়সী নারীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছি। মা মিথ্যা কথা বলতে জানে না। জীবনে কারও কোনো ক্ষতি করেনি। কোনো স্বার্থচিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে না। তাইতো আমার গান-‘একবার ডেকে নে মা ফিরে আসি।’ ক্ষুদিরামের মতো ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি...।’ মায়ের দোয়া আছে বলেই এখনো সসম্মানে বেঁচে আছি এবং সগৌরবে জন্মভিটায় ফিরে যাবো। ক্ষতি হলেও সত্য কথা তো বলতেই হবে। শেষ বয়সে এখন কিছু গোপন করেই বা লাভ কী। আমার অভিশপ্ত জীবনের জন্য তিন জন নারীকে দায়ী করা যায়। এক নারী যৌবনে বলেছিল, আমাকে জীবন সঙ্গী করবে’; যুদ্ধকালে রাজাকারের হাত ধরে চলে গেছে। অপর নারী ফেনীতে আধিপত্য লাভের জন্য আমাকে এলাকাছাড়া করেছে। তৃতীয় নারী বার বার আশ্রয় দিয়েও পরে কুচক্রীদের কথায় বিভ্রান্ত হয়ে আমাকে দলছাড়া করেছিল। সবশেষে বলি, কোনো উপদেষ্টার ওপর ভরসা করে নয় কেবলমাত্র গণমানুষের ওপর ভরসা করে জন্মভূমিতে মাটি পাওয়ার জন্য এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় পাড়ি জমানোর লোভে ঝুঁকি নিয়েই দেশে ফিরবো। জন্ম নয়, মৃত্যুই আসল সত্য। আরও একবার সকলকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছি- মৃত্যুর পর আমার লাশটি যেন মুজিব উদ্যানেই দাফন করা হয়।


‘এ দেশে জন্মে পদাঘাতই শুধু পেলাম
অবাক পৃথিবী সেলাম তোমাকে সেলাম।’



প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি