অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেও অসংখ্য স্বপ্ন আজও অপূর্ণ
পরবর্তী পর্যায়ে ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ সালের প্রথমদিন পর্যন্ত ৫ বছরের ঘটনাগুলো লেখা আরও আলাদা করে দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে প্রকাশ করার ইচ্ছা রইল। তবে যদি হায়াত থাকে দুটোকে একত্রিত করে ফেলব। আমার আত্মকথায় সমকালীন ফেনীর ইতিহাসের রেখাচিত্র অঙ্কন করার চেষ্টা করেছি। আমার বইটিকে ইচ্ছা করলে সংক্ষিপ্ত ইতিহাস হিসেবেও বিবেচনা করতে পারবেন। ইতিহাস সাধারণত রাজ- বাদশাদের কাহিনীতে ভরা থাকে এবং তাদের সঙ্গেই ওই সময়কালের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সামাজিক পরিস্থিতির বর্ণনা উঠে আসে। আমি রাজা-বাদশা নই তবে আমার সমকালের যে সকল বর্ণনা এখানে আছে তাতে ১৯৬০ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়কালে ফেনীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সংসদ সদস্য থাকাকালে শুধু নয় ১৯৭২ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ফেনী অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিলাম। যে সব ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নিজে জড়িত কেবল সেগুলোকেই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তবু কিছু প্রসঙ্গ বা আলোচনা কারও কারও কাছে বাহুল্য মনে হতে পারে ঠিকই। তবে ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে যাতে সেগুলো এই বইটিতে সংক্ষিপ্ত হয় সেই কারণেই কিছু বিষয়কে একটু দূর থেকে টেনে আনতে হয়েছে। স্মৃতির অতলে কত ঘটনা বিলীন হয়ে গেছে তার কোনো ইয়াত্তা নাই। তবুও আজ যেসব ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছি সেটাকেই কেন জানি মনে হচ্ছে সবচাইতে উত্তম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যা কিছু করেছি ভালোমন্দ হয়তো অতি অল্প সময়ে সবই বিলীন হয়ে যাবে। মনে হচ্ছে এই আত্মকথাটি মৃত্যুর পরও আমাকে শত বছর ফেনীর মানুষের কাছে অমর করে রাখবে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “আজ হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসে, আমার কবিতাটি কৌতূহল ভরে? কে বলিতে পারে আমার এই স্মৃতিকথাটি শত বছর পরেও মানুষ কৌতুক হল ভরে পড়বে না। আমার আশা আছে, ইচ্ছা বা স্বপ্ন আছে এই বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে যাব। কেননা আমার ধারণা কম্পিউটারের আগ্রাসন ২০০ বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাকে পৃথিবী থেকে বিলীন করে দেবে। সারা পৃথিবীর সকল মানুষের গ্রহণযোগ্য একটি ভাষা থাকলেও খুবই ভালো হয়। হয়তো কোন পাঠকের কাজে লাগবে না তবু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লব্ধ ধারণার প্রকাশ করে যাব। যেমন আমি মনে করি, দেখতে খুব সুন্দরী নারী-পুরুষের চাইতে আকর্ষণীয় নারী পুরুষরা মানুষ হিসাবে ভালো। এটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। কারণ থাকলে বা হাসার মতো ঘটনা থাকলে নিশ্চয়ই হাসতে হবে এবং কোনো দুঃখ-বেদনার বা শোকের কারণ ঘটলে নিশ্চয়ই কাঁদতে হবে। কিন্ত কোনো কারণ নেই তবু যেসব লোক অতিমাত্রায় হাসে, মনে রাখতে হবে তারা খারাপ লোক। এরা সাধারণত চাটুকর হয় এবং ছল করে স্বার্থ আদায় করতে চায়। অকারণে যারা কাঁদে তারা কুচক্রী, কথায় কথায় যারা সহজে কেঁদে ফেলে তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র করে মানুষকে বিপদে ফেলে। জ্যোতিষশাস্ত্র ঝাঁড়-ফুঁক, ভূত প্রেত ইত্যাদি একেবারেই বিশ্বাস করিনা। শাক-সবজি, ফলমূল, তরিতরকারী খেয়ে এবং পরিশ্রম করে যারা জীবন-যাপন করে নীরোগ দেহে তাদের বয়স ১০০ বছর হতে পারে। সূর্য উঠতেই যারা জেগে ওঠে এবং সূর্য ডুবতেই যারা ঘুমিয়ে পড়ে তারাও অবিশ্বাস্য রকমের স্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে। সত্যবাদিতা এবং সত্য নিয়ে যারা জীবনধারণ করে, সত্যিকারের বুদ্ধিমান তারাই। দীর্ঘদিন ধরে মনের মধ্যে কিছু স্বপ্ন লালন করেছিলাম। প্রথম বছরেই যে সাড়া পেয়েছিলাম তাতে পাঁচ বছর মেয়াদে এটি অবশ্যই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ কলেজে পরিণত হতো। এতে শুধু আমার নয়, সমগ্র ফেনীবাসীর মুখ উজ্জ্বল হতো। স্বপ্ন ছিল এমন একটি হাসপাতাল করা যেখান থেকে সকল জটিল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। কথায় কথায় রোগীদের ঢাকায় পাঠানো বন্ধ করেত চেয়েছিলাম। সকল প্রকার যন্ত্রপাতি ও অভিজ্ঞ ডাক্তার দিয়ে এটিকে সমৃদ্ধ করেতে চেয়েছিলাম। ভারতের ভোলোরের মতো, জটিল রোগ নিয়ে সারাদেশ থেকে লোকরা এসে অল্প পয়সায় চিকিৎসা নিয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যে ডায়বেটিক হাসপাতালকে পরিচালনা করা শুরু করেছিলাম। আমার এই স্বপ্নের কথা ডাক্তার বায়েজিদ, আসাদুল্লা ফারুক, মোফাখখার আহাম্মেদরা জানত। প্রথমেই ডিসি, এসপি, এডিসির রেভিনিউ সাব-রেজিস্ট্রার ও কয়েকজন ডাক্তারসহ কয়েকটি মিটিং করেছিলাম এবং সিদ্ধান্ত হয়েছিল সপ্তাহের মধ্যে ডায়বেটিক হাসপাতাল কমিটি প্রধানের নামে দুই কোটি টাকা জমা হবে এবং এই টাক ফিক্সট ডিপোজিট হিসেবে থাকবে। এর ১ কোটি টাকার সুদ থেকে প্রাপ্ত অংশ ডাক্তারসহ স্টাফরা বর্ধিত বেতন ভাতা পাবে। অপর ১ কোটি থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশ দিয়ে অতি গরিব লোকদের চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা হবে। এই উদ্যোগে ডিসি নাগ বাবু আন্তরিক সহযোগিতা করেছিলেন। ১ কোটি টাকা লন্ডনে প্রবাসী ফেনীর লোকরা এবং ১ কোটি সৌদি আরবের প্রবাসী ফেনীর লোকেরা যোগাড় করে দিতে খুবই আগ্রহী ছিল। পরিকল্পনার কথা শুনে বালুমহল কমিটি ও ঠিকাদার সমিতি কিছু টাকার যোগান দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে এসব এখনো অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আল্লাহ যদি সুযোগ দেয় আমি এর বাস্তবায়ন করে যাওয়ার আশা রাখি। স্বপ্ন ছিল পাঁচ বছর মেয়াদি ক্যাম্প করে ৫০ জন ছেলেকে ফুটবল ও ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক মানের দুটি টিম গড়ে তুলব। ক্যাম্পে থাকাকালে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে প্রয়োজন বিবেচনায় ৫/১০ হাজার টাকা ভাতা দেয়ার চিন্তা ছিল। এই ৫ বছরের সাধনায় শুধু ফেনী থেকেই বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে পারে এমন একটি টিম গঠন করা সম্ভব। আমার এসব উচ্চবিলাসী স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত করে হয়তো যেতে পারব না। তবে কেউ যদি এসব বাস্তবায়ন করতে পারেন পরপারে আমার আত্মা শান্তি পাবে। হাই রোড থেকে ডিসি অফিস পর্যন্ত পূর্ব পশ্চিমে যে রাস্তাটি করেছি তার দুপাশে ১০ ফিট করে দুটি পাকা লেক করার এবং পুরো ১ কিলোমিটার রাস্তার উপরে রঙিন টিনের শেট দেয়ার পরিকল্পনা ছিল। লেকগুলোতে দুটি স্পিড বোর্ড রাখারও চিন্তা ছিল। স্পিড বোর্ডে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত আসতে ৩০ সেকেন্ড সময় লাগত। লেকগুলোতে মাছ চাষ করলেও মাসে লক্ষ টাকা আয় করা সম্ভব ছিল। শুধু একটু ব্যবস্থা করলেই প্রতি বিকেলে কয়েক হাজার মানুষ জড় হতো। এখন অত্যাধুনিক কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার গড়ে তোলার প্রবল ইচ্ছ বা স্বপ্ন ছিল। একটি সর্বাঙ্গীণ স্মৃতি কথা বা আত্মকথা প্রকাশ করার অনেক দিনের স্বপ্ন ছিল। এটা অনেকবার সভা-সমিতি ও সাংবাদিক বন্ধুদের বলেছি। অন্যসব স্বপ্নগুলো বাস্তবায়ন করতে পারব কিনা জানি না। তবে আল্লাহর রহমতে আশা করছি, আত্মকথাটি লিখে প্রকাশ করার স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হবে বলে আশা করছি। এটি বাস্তবায়িত হলে জীবনে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে বলে বিবেচনা করব।