শিরোনাম: |
স্বাধীন দেশে রিমান্ড চলতে পারে না
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
![]() তার সঙ্গে আমার পরিচয় সম্প্রতি, পরীমনির মামলাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু তার পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের। অ্যাডভোকেট পান্না বরিশালের বিখ্যাত সাবেক রাজনৈতিক নেতা খান বাহাদুর হাশেম আলী খানের নাতি। হাশেম আলী খান ছিলের শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহচর। ফজলুল হক যখন প্রোগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি গঠন করেন, তখন হাশেম আলী খান ছিলেন সেই মন্ত্রিসভার সমবায়মন্ত্রী। পাকিস্তান আমলে সম্ভবত ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে নির্বাচনি প্রচারণায় বের হয়ে ঝড়ে নৌকাডুবিতে তিনি মারা যান। হাশেম আলী খানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্য উত্তরাধিকার এখন বহন করছেন আইনজীবী পান্না। তিনি যেমন বলেছেন, পরীমনিকে তিনি চিনতেন না, এই অসহায় তরুণী চিত্রনায়িকার ওপর অন্যায় হচ্ছে জেনে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। আমি তেমনি পরীমনিকে দু-একটি ছবিতে নায়িকা চরিত্রে দেখা ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। কিন্তু তার ওপর পুলিশের অন্যায় ব্যবহার এবং নিম্ন আদালতের বিচারকদের সংবিধান লঙ্ঘন করে বারবার রিমান্ডে পাঠানো দেখে আমারও মনে হয়েছে বিচারের বাণী নীরবে নিতৃতে কাঁদছে। পরীমনিকে সাহায্য ও সমর্থন করা দরকার। আমি ভাষা আন্দোলনে জেলে গেছি। কিন্তু রিমান্ডে কখনো যাইনি। কিন্তু আমার কিছু তরুণ রাজনৈতিক বন্ধু-বান্ধবের রিমান্ডে যাওয়ার বিবরণ শুনে শিহরিত হয়েছি। বামপন্থি তরুণেরা সেই পাকিস্তান আমলে রিমান্ডে গেলে হাত-পা ভাঙা অবস্থায় বেরুতে দেখেছি। ঐ আমলে একুশ-বাইশ বছরের এক সুশ্রী গ্রামের মেয়েকে ডাকাতির মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ডাকাতদের খবর বের করার জন্য সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছিল পুলিশ। নিম্ন আদালতের সদাশয় ম্যাজিস্ট্রেট মেয়েটিকে পাঁচ দিনের জন্য রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। পুলিশ কাস্টোডিতেই হতভাগ্য মেয়েটির মৃত্যু হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, মেয়েটির হৃদরোগ ছিল। রিমান্ডে থাকার সময় তার এই রোগ দেখা দেয় এবং চিকিত্সক ডাকা হলেও মেয়েটি আর চিকিত্সার সুযোগ পাননি। তার আগেই তরুণীর মৃত্যু হয়। তরুণীর যে আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে, সেটা সত্যায়িত করার জন্য একজন চিকিৎসকের কাছ থেকে ডেথ সার্টিফিকেট জোগাড় করা হয়। পুলিশ কাস্টোডিতে এই গ্রাম্য মেয়েটির মৃত্যু হওয়ায় তখন দারুণ হইচই হয়। তার মৃতদেহ পোস্টমর্টেমের আদেশ হয়। এই পোস্টমর্টেমের পর জানা যায়, হৃদরোগে নয়, মেয়েটি পৈশাচিক গণধর্ষণের ফলে মারা গেছে। ঐ পর্যন্তই। এই গণধর্ষণের দায়ে পুলিশদের কারো বিচার ও দণ্ড হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। সম্প্রতি ঢাকায় যখন পুলিশ ও র্যাব পরীমনির বাসায় হামলা চালায়, তখন সেই ভয়াবহ হামলা ফেসবুক লাইভে দেখার পর আমি স্থির থাকতে পারিনি। আমার মনে পড়েছে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় কৃষক আন্দোলনের বিখ্যাত নেত্রী ইলা মিত্রের গ্রেফতারের দৃশ্য। তাকে সন্ত্রাসী বলে দেখানো হয়েছিল। পাকিস্তানের পুলিশ তাকে যুদ্ধযাত্রার বেশে ধরে এনেছিল এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছিল। দীর্ঘদিন রিমান্ডে থাকার পর সকলের শ্রদ্ধাভাজন এই কৃষক নেত্রীকে (তখন তিনি যৌবন পার হননি) মৃতপ্রায় অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ ইলা মিত্রের প্রাণ বাঁচানোর জন্য রক্ত চেয়ে জনসাধারণের কাছে আবেদন জানান। ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা যায়, পুলিশ কাস্টোডিতে থাকার সময় ইলা মিত্র বারম্বার গণধর্ষণের শিকার হন। ঢাকায় একটু সুস্থ হওয়ার পর তিনি কলকাতায় চলে যান। তিনি পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভায় সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিছুকাল আগে তার মৃত্যু হয়। ইলামিত্রের ঘটনার সময় আমি কলেজের ছাত্র। তাকে রক্তদানের জন্য লম্বা গণলাইনেও দাঁড়িয়েছিলাম। আমি ঘরপোড়া গরু। তাই বৃদ্ধ বয়সেও তরুণী এবং সুন্দরী এক চিত্রনায়িকার বাড়িতে সন্ত্রাসী ও ডাকাত ধরার মতো ভয়াবহ বেশে পুলিশের অভিযান দেখে ইলামিত্রকে ধরার অভিযানের কথা মনে পড়েছে। র্যাব সন্ত্রাসী ও ডাকাত ধরার জন্য গঠন করা হয়েছে। দেশের এক সাধারণ নাগরিক, তার ওপর সাতাশ-আটাশ বয়সের এক তরুণীকে ধরার জন্য মশা মারতে কেন কামান দাগানো হয়েছিল তা বুঝতে পারছিলাম না। পরীমনির ‘আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও’ আর্তনাদ আমাকে অভিভূত করে ফেলেছিল। তাকে যে কোনোভাবে সাহায্য দানের জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। হাসিনা সরকারের আমলে একটি সুশিক্ষিত ও সুদক্ষ পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছে। তাদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। কিন্তু পুরোনো কলোনিয়াল আমলের কিছু পুলিশ এখনো রয়ে গেছে। তাদের কার্যকলাপই পুলিশের সুনাম নষ্ট করছে। অন্যদিকে সন্ত্রাস দমনে র্যাবের প্রশংসা আজ বিশ্বময়। আগামী দিনে বাংলাদেশে তালেবান বা অন্য কোনো ধরনের সন্ত্রাসী অভ্যুত্থানের আশঙ্কা দেখা দিলে র্যাব তা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারবে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। র্যাব তৈরিই করা হয়েছিল দেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য। মাদক ব্যবসায়ের সিন্ডিকেটের নেতাদের ধরার জন্যও র্যাবকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু মশা মারতে কামান ব্যবহার কেন? পরীমনির মতো এক নিরীহ তরুণীকে গ্রেফতারের জন্য ‘আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনী’ লেলিয়ে দেওয়া কেন? দুই ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম এবং দেবব্রত বিশ্বাস নিয়মরীতি, সংবিধানের ধারা ভঙ্গ করে পরীমনিকে চারবার রিমান্ডে পাঠালেন কেন? তার জামিন শুনানির দিন দীর্ঘ প্রায় এক মাস পিছিয়ে দেওয়া হলো কেন? অর্থাৎ বিনা বিচারেই পরীমনির এক মাস কারাবাস নির্ধারণ করলেন দুই ম্যাজিস্ট্রেট কাদের উসকানিতে, কাদের ধমকে? আমার এখানেই ভয় ছিল। শিয়ালের কাছে মুরগিছানা ছেড়ে দেওয়া হলো নাকি? অবশ্য সব পুলিশ শিয়াল নয়। ভালো পুলিশও আছে। কিন্তু এখনো তারা সংখ্যায় কম। মন্দ পুলিশের লোলুপ দৃষ্টি থেকে কত ক্ষণ তারা এক রূপসী তরুণীর সম্মান রক্ষা করতে পারবেন? আইনজীবী জেড আই খান পান্নার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। তিনি পরীমনির আইনজীবী না হয়েও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে পরীমনির কেসটির দিকে মাননীয় হাইকোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মহামান্য হাইকোর্ট সঙ্গে সঙ্গে পরীমনির জামিনের আবেদনের দিন এগিয়ে আনার হুকুম দেন এবং এই ব্যাপারে দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যকলাপের কৈফিয়ত তলব করেন। তাদের কার্যকলাপ ‘সভ্য নয়’ বলেও হাইকোর্ট মন্তব্য করে। দুই ম্যাজিস্ট্রেট ভুল বা অপরাধ করেছেন বলে স্বীকার করেননি। যদি ভুল হয়ে থাকে তাহলে তারা ক্ষমাপ্রার্থী। পরীমনিকে বারবার রিমান্ডে পাঠিয়ে তারা যে সংবিধান ভঙ্গ করেছেন, তা তাদের দেখিয়ে দেওয়ার পরেও ভুল স্বীকার না করে এখনো বলছেন, ‘যদি তারা ভুল করে থাকেন,’ হাইকোর্ট তাদের কৈফিয়ত মেনে নেননি। দুই ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে হয়তো তারা আরো ব্যবস্থা নেবেন। আমি আইনবিদ নই। বিচারপতি সুলভ মহানুভবতাও আমার নেই। মহামান্য আদালতকে সম্মান জানিয়ে বলছি নিম্ন আদালতের বিচারব্যবস্থা থেকে দুর্নীতি, উেকাচ, ক্ষমতার অপব্যবহার দূর করার লক্ষ্যে এই দুই ম্যাজিস্ট্রেটকে সংবিধান ও হাইকোর্ট অবমাননার জন্য গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করা উচিত। পরীমনির মামলায় ঢাকা হাইকোর্টের মহামান্য দুই বিচারপতি জাস্টিস মোস্তফা কামাল ইসলাম এবং জাস্টিস জাহিদ সারোয়ার সুবিচার ও আইনের সুশাসন রক্ষায় যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, সেজন্যে তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। প্রশ্নটা শুধু এই দুই দুষ্ট বুদ্ধির ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম ও দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে নয়। তারা কলোনিয়াল আমলের জরাজীর্ণ একটা সিস্টেমের অংশ। এই সিস্টেমটি দুর্নীতিতেপূর্ণ। এদের অধিকাংশের মাথার ওপরে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের রুই-কাতলাদের আধিপত্য। এমনও দেখা গেছে, কলেজে পড়ুয়া সুন্দরী বিবাহিত ছাত্রী। তার ওপর স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের এমপিপুত্রের নজর পড়েছে। কোনোভাবে তাকে পটাতে না পারায় তার স্বামীকে হত্যা করে তাকে স্বামী হত্যার মামলায় আসামি করা হলো। পুলিশও মেয়েটিকে রিমান্ডে নিয়ে সহজেই তার অপরাধ স্বীকারের জবানবন্দি নিল। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুলিশ রিপোর্টের ভিত্তিতে মেয়েটির ফাঁসির দণ্ড দিয়ে দিল। তরুণী এখন জেলে ফাঁসির আসামির সেলে বাস করছে। শুনেছি এই কেসেও হাইকোর্টে মেয়েটির আইনজীবী হয়ে দাঁড়াবেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না। আমি তার সাফল্য কামনা করি। আসলে অভিযুক্তকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রথাটা কোনো স্বাধীন দেশে নেই। এটা প্রবর্তন করেছিল ব্রিটিশ সরকার। দেশ স্বাধীন করার জন্য দুঃসাহসী যুবকেরা তখন সন্ত্রাসী দল গঠন করেছিল। এদের গ্রেফতার করতে পারলে থানায় এনে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে খবর আদায় করা হতো। অনেক বিপ্লবী এই নির্যাতনে মারা গেছেন। এছাড়া দুর্ধর্ষ ডাকাত ধরা পড়লে থানায় আনা হতো। তাদের ডান্ডাবেড়ি পরানো হতো। তারপর অপরাধ স্বীকার না করলে অথবা সঙ্গী-সাথীদের খোঁজ না দিলে মেরে তাদের হাড় গুঁড়া করে দেওয়া হতো। পাকিস্তান বহু ঔপনিবেশিক আইন বাতিল করেছে। এই আইনটি করেনি। রাজনৈতিক বিরোধীদের বিশেষ করে বামপন্থি রাজবন্দিদের ওপর এই আইনটি প্রয়োগ করত। রিমান্ডে নিয়ে ইন্টারোগেসনের নামে তাদের ওপর নির্যাতন চালাতো। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রিমান্ডে নেওয়ার এই কালাকানুনটি বাতিল হয়নি। যারই সুযোগ নিচ্ছে একশ্রেণির থানাপুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট। বঙ্গবন্ধুর বিচারব্যবস্থা ও বিচারপ্রক্রিয়া সংশোধনের বিরাট ইচ্ছা ছিল। তাকে রিমান্ডে নেওয়া না হলেও বিনা বিচারে নিরাপত্তা আইনে জেলে নিয়ে পাগলা গারদে রাখা হয়েছে। রাত্রে ঘুমোবার সময় হাইভোল্টেজ বাল্প চোখের ওপর জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাতে দেওয়া হয়নি। রাজবন্দিদের ওপর এই বেআইনি ও অমানুষিক অত্যাচার বন্ধ করার জন্য বঙ্গবন্ধু তার বাকশাল পরিকল্পনায় বিচারব্যবস্থাকে নির্বাহী বিভাগের কবজামুক্ত করা এবং জেল সংস্কারের বিশাল কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আকস্মিকভাবে ঘাতকদের হাতে নিহত হওয়ায় বঙ্গবন্ধু তার এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথে তেমন এগুতে পারেনি। জিয়াউর রহমানের পাকিস্তানের কাছ থেকে ধার করা পচা ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাতেই দেশের বিচার বিভাগ চালিত হচ্ছে। চালিত হচ্ছে নির্বাহী বিভাগের হুকুমে। নির্বাহী বিভাগের আধিপত্যের কাছে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্রমশ খর্ব হচ্ছে। আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা বাড়ছে। এই অবস্থায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত না হওয়া, এই বিভাগের সংস্কার ও সংশোধনের আশা করা যায় না। রিমান্ড-প্রথা বাতিল করাতো দূরের কথা। তবু একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই, একটি স্বাধীন দেশে রিমান্ড চলতে পারে না। |