বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, 2০২4
তালেবানরা এবার ক্ষমতায় বসে কী করবে?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Monday, 6 September, 2021 at 8:43 PM

আফগানিস্তানে তালেবান শাসন স্থায়ী হবে কি না জানিনা, তবে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। এ সরকারের চেহারা কী হবে, মধ্যযুগীয় চেঙ্গিস খান বা হালাকু খানের রাজত্ব, না একটু ভদ্র, সভ্য, আধুনিক চেহারার তালেবান? যারা নতুন তালেবান সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন, তাদের চেহারা-সুরতের সঙ্গে আগের তালেবান সরকারের সদস্যদের চেহারা-সুরতের কোনো পার্থক্য নেই। তবে এবার নতুন তালেবান শাসকদের চরিত্রে পরিবর্তন দেখা যেতে পারে। অর্থাৎ আগেকার বর্বর চেহারা হয়তো তারা দেখাবেন না। কারণ, আফগানিস্তানকে ঘিরে বিশ্ব রাজনীতির একটা ত্রিকোণ পরিবর্তন ঘটেছে।

আগেরবার তালেবান শাসনের পেছনে ছিল কেবল মার্কিন মদদ। এবার এ মদদদানের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে তুরস্ক, চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান মিলে নতুন শক্তি ব্লক তৈরি হয়েছে। এখানে আমেরিকার ভূমিকা কী হবে? প্রেসিডেন্ট বাইডেন জোরালো ভাষায় বলেছেন, তিনি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে এনে অর্থাৎ তালেবানদের ক্ষমতায় বসতে দিয়ে কোনো ভুল করেননি। এখন নতুন চার শক্তি বলয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তারা তালেবানদের সমর্থন দেবেন, না ইউরোপিয়ান দেশ ও ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তালেবানদের বিরুদ্ধে না হলেও নতুন কোনো নীতি অনুসরণ করবেন, তা দেখার রইল।

দীর্ঘ কুড়ি বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তালেবানরা বুঝে নিয়েছে, অস্ত্র বলে কাবুলে তাদের দখল স্থায়ী করা সম্ভব নয়। সম্ভবত তারা মডারেট নীতি অনুসরণ করবে এ প্রতিশ্রুতি দিয়েই আমেরিকার কাছ থেকে কাবুল দখলের অনুমতি পেয়েছে। একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন ও রাশিয়াকে। তাদের দেশে তালেবান আর উপদ্রব সৃষ্টি করবে না। ভারতকেও তারা একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা কাশ্মীরে নাক গলাবে না। ভারতের বন্ধুত্ব তারা কামনা করেছে।

বাংলাদেশে তালেবানি উৎপাত কিছু দিন আগেও বড় উৎপাত ছিল। এ উৎপাত আর সৃষ্টি করা হবে না-এ প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশ পেয়েছে কিনা আমি জানিনা। তবে গত শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) লন্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনারের বাসভবনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা গওহর রিজভির খোশ মেজাজ দেখে মনে হলো, তালেবান সমস্যা নিয়ে তারা তেমন চিন্তিত নন। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তালেবানরা বর্বরতা ত্যাগ করে দেশটিকে আধুনিক কায়দায় শাসন করার প্রমাণ দিলে তাদের সঙ্গে কাজ করতে বাংলাদেশের আপত্তি থাকবে না। এটা ইউরোপিয়ান কমিশন ও বড় বড় ইউরোপিয়ান দেশগুলোরও কথা।

যদি আইএস, মুজাহিদ বা অন্য কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবানদের ওপর বড় আঘাত করতে না পারে, তাহলে আপাতত তালেবান শাসন নিশ্চিত। কিন্তু রণক্লান্ত আমেরিকা তালেবানদের হাতে আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘকাল মধ্যপ্রাচ্যে রণেভঙ্গ দিয়ে কি থাকবে? বাইডেন সাহেব যতই বলুন আমেরিকা আর বিদেশে কোনো হস্তক্ষেপ করতে যাবে না, অর্থাৎ অতীতের প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মতো বহির্বিশ্বে পুলিশের ভূমিকা আর পালন করতে চাইবে না, তা কতটা সত্য? আমেরিকা কি চেয়ে চেয়ে নিষ্ক্রিয়ভাবে দেখবে পশ্চিম এশিয়ার প্রবেশে এবং সেখানে অর্থনৈতিক বাজার চীন একাকী দখল করে ফেলুক? অস্ত্র ব্যবসায়ের মার্কেট দখল করুক রাশিয়া? আর তুরস্ক ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বিস্তার করুক সারা পশ্চিম এশিয়ায়? পাকিস্তান ভারতের শতাব্দীকালের প্রাচীন মৈত্রী ভেঙে দিয়ে আফগান রাজনীতি নিতে পারবে নিজের কব্জায়? বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে আফগান তালেবানরা কোনোভাবেই আর উসকাবে না, বলবে নিজের চরকায় তেল দাও?

এতগুলো প্রশ্নের জবাব একসঙ্গে দেওয়া যাবে না। আমার ধারণা, ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে তালেবানরা এখন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে মডারেট চেহারা ধারণ করবে। কাউকে খুঁচিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে চাইবে না। তবে দুনৌকায় পা দিয়ে তালেবানরা কতদিন দেশ চালাতে পারবে সেটাই প্রশ্ন। আফগানিস্তানে বাদশাহ জহির শাহের আমলে এমনটা ঘটেছিল, একদিকে মার্কিন ডলার এবং অন্যদিকে রাশিয়ার রুবল। উভয়ের উদার ও অকৃপণ সাহায্যে আফগানিস্তানে বিরাট উন্নয়নের ঢেউ জেগেছিল। বেশিদিন এটা টেকেনি। শিগ্গির শক্তি পরীক্ষা দেখা দিল ডলার ও রুবলের মধ্যে। প্রথমে রুবল জয়ী, কল্লা কাটা গেল নিরপেক্ষ উদারপন্থি সরকারের প্রধান সরদার দাউদ খানের। তাকে হত্যা করে রুবল একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল আফগানিস্তানে।

ডলার তা সহ্য করেনি। পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশে তালেবান, মুজাহিদ গোষ্ঠীকে সশস্ত্র যুদ্ধের তালিম দিয়ে এবং ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা বাহিনীকে সাহায্য জুগিয়ে আফগানিস্তানে আমেরিকা কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায় এবং তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠা করে। আফগানিস্তানে মধ্যযুগীয় প্রথা চালু হয়। নারী শিক্ষা বন্ধ হয়, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে বোরকা পরতে হবে, পুরুষদের দাড়ি রাখতে হবে ইত্যাদি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থায় আফগান নর-নারীর দেশত্যাগ শুরু হয়। অতঃপর নিউইয়র্কে নাইন-ইলেভেনের ঘটনায় আমেরিকা লাদেনকে ধরতে গিয়ে তালেবানবিরোধী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কাবুলে তালেবান শাসনের অবসান হয়। এতকাল চলছিল মার্কিন সেনার পাহারায় কাবুলে তাঁবেদার সরকারের শাসন। রণক্লান্ত মার্কিন সৈন্য বাইডেন সাহেব প্রত্যাহার করে নেওয়ায় তাঁবেদার সরকারের পতন ঘটেছে। কাবুলে তালেবান শাসন ফিরে এসেছে।

ক্ষমতায় স্থিত হয়ে এবার সঙ্গে সঙ্গে তারা আমেরিকা, ইউরোপের বড় বড় দেশগুলোকে চটাতে সাহস করবে তা মনে হয় না। কাশ্মীরে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে ভারতকে চটাবে তাও মনে হয় না। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তারা শরিয়া শাসনের নামে কট্টর ওয়াহাবিজম প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, এটা স্বতঃসিদ্ধ। নইলে তাদের অস্তিত্ব থাকে না। সেই বাদশাহ আমানুল্লার জমানা থেকেই দেখা যায়, আফগান সমাজে ধর্মের প্রতি একটা অন্ধপ্রীতি। এ অন্ধপ্রীতি থেকে বিভিন্ন জির্গায় তালেবানদের প্রতি একটা উষ্ণ সমর্থন কাজ করেছে। এই সমর্থনই আফগানিস্তানে তালেবানদের শক্তির ভিত্তি। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত শ্রেণি খুবই সংখ্যাল্প হওয়ায় তারা তালেবান শাসনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। আমেরিকাও এ প্রতিরোধগুলোকে ধ্বংস করে।

এবার অবস্থা ভিন্ন। তালেবান শাসনে ভীত শিক্ষিত নাগরিকদের সবাই দেশত্যাগ করতে পারেনি। যারা দেশত্যাগ করতে পারেনি, তারা গোপনে তালেবানবিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুদিন আগে তাদের একটি গ্রুপ তালেবান পতাকা ওড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আফগান জাতীয় পতাকা নিয়ে কাবুলে শোভাযাত্রা করেছে।

আল কায়দা ও তালেবানরা যে ইসলামের কথা বলে, তা প্রকৃত ইসলাম নয়। তা হলো ওয়াহাবিজম। কেউ কেউ বলেন, কট্টর ইসলাম। সৌদি আরব এ ওয়াহাবিজম দ্বারা এতদিন শাসিত হয়েছে। তালেবানদেরও প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল সৌদি রাজতন্ত্র। এখন সৌদি আরবে ওয়াহাবি শাসন ভেঙে পড়ছে। রাজতন্ত্র রক্ষার জন্য সৌদি আরবের বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স সালমান দেশে ব্যাপক সমাজ সংস্কার শুরু করেছেন। নারীদের শিক্ষা গ্রহণ ও চাকরি করার কোনো বাধানিষেধ নেই। সিনেমা গৃহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শিক্ষব্যবস্থায় আধুনিকতা আনয়ন করা হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হলে যেমন বিশ্বের সব দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পতন ঘটেছিল, তেমনি অনেকেই মনে করেন, সৌদি আরবে ওয়াহাবিজমের পরিবর্তন অথবা পতন হলে বিশ্বে উগ্র ধর্মবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনও দুর্বল হয়ে যেতে পারে।

পাকিস্তানের পর বাংলাদেশেই তালেবানদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা বেশি। বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থাও তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠার অনুকূল। কিন্তু হাসিনা সরকার দীর্ঘ তিন দফা শাসন ক্ষমতায় থেকে দেশে জামায়াতি ও হেফাজতিদের দমন করে মধ্যযুগীয় ধর্মবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের শিকড় উপড়ে ফেলেছেন। নতুন তালেবান সরকার এ মরা শিকড়ে পানি ঢালতে আসবে মনে হয় না।

বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট রাজনীতিতে নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের মহাজোট তো আছেই। কিন্তু নির্বাচন এলে মহাজোটের বামপন্থি শরিকরা অনেকে মহাজোটে থাকবেন এমন সম্ভাবনা কম। নতুন গণতান্ত্রিক জোট গঠিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে আওয়ামী লীগ আবার ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে সংগঠিত হতে এবং বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোকে সঙ্গে রাখতে না পারলে নির্বাচনের ফল সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অসম্ভব।

যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ধরে রাখতে না পারে এবং বিএনপির নেতৃত্বে ধর্মীয় রাজনীতির জোট ক্ষমতায় আসে, তাহলে আফগান তালেবানদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে হবে না। পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশ একটা আধাতালেবান রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। এটা যদি ঘটে, তাহলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত অংশকে দেশত্যাগে বাধ্য হতে হবে। বাংলাদেশে এ অবস্থা ভারতে যে ধরনের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, সহ্য করবে মনে হয় না। চীন-ভারত উগ্র স্নায়ুযুদ্ধও বাংলাদেশকে গ্রাস করতে পারে। আফগান তালেবানেরা ভারত ও চীনের সঙ্গে যতই সমমৈত্রীর কথা বলুক, শেষ পর্যন্ত একটি পক্ষ তাদের বেছে নিতেই হবে। সম্ভবত সেটি হবে চীন। বাংলাদেশকেও চীন-ভারত স্নায়ুযুদ্ধে একটি পক্ষে টানার চেষ্টা হবে। কেবল হাসিনা সরকার ক্ষমতায় থাকলে এ রশি টানাটানি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত রাখা সম্ভব হবে।

আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন যতই মডারেট চেহারা ধারণ করুক, দীর্ঘস্থায়ী হবে মনে করি না। বাংলাদেশকে তালেবানি শাসন থেকে মুক্ত থাকতে হলে নিজের সামাজিক ব্যবস্থাকে তালেবানি প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। আওয়ামী লীগ এবং দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি এখনই সতর্ক না হলে বাংলাদেশে বাইরে থেকে তালেবানদের আসতে হবে না, ভেতর থেকেই তা গজিয়ে উঠবে।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি