শিরোনাম: |
পরীমনির ঘটনা এবং আমাদের সামাজিক অবক্ষয়
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
একটি বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠার সময় অনেক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে ওঠে। সেই মূল্যবোধ বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। একটি সুসভ্য বুর্জোয়া শ্রেণিও গড়ে ওঠেনি। যে পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদেরও ক্রমবিকাশ ঘটেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার সুবাদে লুটপাট করে একটা নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারা পাশ্চাত্যের সবকিছুর অনুকরণ করছে, কিন্তু তার ভালো কিছু গ্রহণ করতে পারেনি। তারই পরিণামে তারা ইতালির মাফিয়াদের মতো আচরণ করছে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা যে পাতি বুর্জোয়া স্তর অতিক্রম করতে পারেনি, তার একটা প্রমাণ সাম্প্রতিক পরীমনি ধর্ষণচেষ্টা, মুনিয়া হত্যাকা-(?) ইত্যাদি। আমার ধারণা ছিল, সমাজে লুণ্ঠনকারীদের ধন লুণ্ঠনের তৎপরতা এত বেশি ছিল যে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে একটি পাকাপোক্ত বুর্জোয়া সমাজ গড়ে উঠেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলি প্রমাণ করে, আমাদের সমাজ, এত লুটপাট সত্ত্বেও, পাতি বুর্জোয়া স্তরেই রয়ে গেছে। আমাদের সমাজ বুর্জোয়া স্তরে উন্নীত হলে নারী অপহরণ ও ধর্ষণের কা-টা অন্যরকম হতো।
পরীমনিকে যেভাবে নাইট ক্লাবে নিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে, তা হতো না। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের বুর্জোয়া শ্রেণি এ ধরনের অপরাধ করেছে, কিন্তু তা দীর্ঘদিন ঢাকা ছিল। প্রকাশ্যে বেলাল্লাপনা হয়নি। আমেরিকায় ওয়েস্টিনের ঘটনায় দেখা যায়, তিনি তার ধন ও প্রভাবের জোরে হলিউডের নামকরা নায়িকাদের নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করেছেন। তা কখনো জনসমক্ষে আসেনি। একটি আকস্মিক ঘটনায় তিনি ধরা পড়েন এবং দেখা যায় হলিউডের নামকরা অধিকাংশ নায়িকা তার যৌন লালসার শিকার হয়েছিলেন। কেউ কেউ কৌশলে রক্ষা পান। কিন্তু তারাও পরে প্রকাশ্যে মুখ খোলেন। বিশ্বব্যাপী শুরু হয় মি-টু আন্দোলন। এই আন্দোলন সারা ইউরোপ ছড়িয়ে ভারতের বলিউড পর্যন্ত প্রসারিত হয়। বড় তারকারা প্রকাশ করতে শুরু করেন। তারা তাদের পরিচালক, সহ-অভিনেতা, প্রযোজক দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন। এটা হলো উচ্চ বুর্জোয়া সমাজের অভ্যন্তরীণ কেলেঙ্কারি। এটা আকস্মিকভাবে প্রকাশ পাওয়ায় ওয়েস্টিন জেলে গেছেন। এমনকি ব্রিটিশ রাজকুমার অ্যান্ড্রুজ একই অভিযোগে অনেক রাজকীয় দায়িত্ব ও সম্মান হারিয়েছেন। একটি বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠার সময় অনেক মূল্যবোধ নিয়ে গড়ে ওঠে। সেই মূল্যবোধ বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। একটি সুসভ্য বুর্জোয়া শ্রেণিও গড়ে ওঠেনি। যে পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদেরও ক্রমবিকাশ ঘটেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার সুবাদে লুটপাট করে একটা নব্য ধনিক শ্রেণি গড়ে উঠেছে। তারা পাশ্চাত্যের সবকিছুর অনুকরণ করছে, কিন্তু তার ভালো কিছু গ্রহণ করতে পারেনি। তারই পরিণামে তারা ইতালির মাফিয়াদের মতো আচরণ করছে। আজকের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের যে বিরাট অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েছে, তার ফসলও নব্য ধনীরা লুটপাট করছে। পরীমনি এখন বাংলাদেশের একজন সেলিব্রেটি। তাই তার ঘটনাটি নিয়ে মিডিয়া তোলপাড় করেছে। কিন্তু সেলিব্রেটি নন এমন বহু নারী ইতিপূর্বে একইভাবে নিগৃহীত হয়েছেন। কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের খোঁজ মিডিয়ায় তেমন নেই। পরিমনির ঘটনাতেই এখন বোঝা যায় আমাদের এই পাতি বুর্জোয়াদের একটা শ্রেণি ইতালির মাফিয়াদের মতো কতটা নির্লজ্জ ও দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয়, পরীমনিকে যেভাবে ধর্ষণচেষ্টার পর ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য নানাভাবে নানা প্রচার চালানো হচ্ছে, তার ব্যক্তিগত চরিত্র হরণের চেষ্টা চলছে, এটা পাশ্চাত্য জগতেও দেখা গেছে। একজন হলিউডি নায়িকাকে ধর্ষণচেষ্টার পর যখন সেটা জানাজানি হয়েছে, তখন সেই নায়িকাকেই সমাজের চোখে দোষী সাব্যস্ত করানোর জন্য তার ব্যক্তিগত জীবনের ছবি সংগ্রহ করে তাকে চরিত্রহীনা প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে। পরিমনির বেলায়ও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আমি পরীমনিকে একটা কারণে ধন্যবাদ জানাব, তিনি তার ধর্ষণচেষ্টার ঘটনাটি ঢাকা না রেখে তা ফাঁস করার জন্য প্রকাশ্যে এগিয়ে এসেছেন। এর ফলে আমাদের পাঁতি বুর্জোয়া সমাজের কলঙ্কিত চেহারার দিকটি বেরিয়ে এসেছে এবং দেশের মানুষ জানতে পেরেছে, আমাদের দেশেও একটি ধনী মাফিয়া শ্রেণি গড়ে উঠছে, যাদের কাছে কোনো নীতিবোধ ও সামাজিক মূল্যবোধ নেই। নাইট ক্লাবে মধ্যরাতে পরীমনির ঘটনাটিতে প্রকৃত দায়ী কে তা আদালত স্থির করবে। এই বিচার সম্পর্কে আমার কিছু বলার নেই। আমার সাংবাদিক অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা জন্মেছে, ইতালির মাফিয়াদের কা-কীর্তি এবং ঢাকার সাম্প্রতিক নারীঘটিত ঘটনাগুলোর মধ্যে পার্থক্য কম। কেউ কেউ আমাকে বলেছেন পরিমনির মতো একজন সুন্দরী নায়িকা অত গভীর রাতে নাইট ক্লাবে গিয়েছিলেন কেন? এ ক্ষেত্রে আমার জবাব, পুরুষদের যদি যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে যাওয়ার অধিকার থাকে, সেই অধিকার নারীদেরও দিতে হবে। কোনো নারী যদি সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হন, নিগৃহীত হন, তাহলে বুঝতে হবে সেজন্য সমাজ দায়ী। ঐ নারী দায়ী নন। শেখ হাসিনার শাসনামলের বৈশিষ্ট্য নারীর ক্ষমতায়ন। আজ বিচারক থেকে পুলিশ, পুলিশ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, জাতীয় সংসদদের স্পিকার পদে নারী। প্রধানমন্ত্রী নিজেও একজন নারী। নারীর ক্ষমতায়নের এই যুগে তার কোন অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হলে তা সমীচীন হবে না। আমাদের বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় যদি দূর করা যায়, তাহলে সরকারের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সামাজিক উন্নতি যুক্ত হয়ে বাংলাদেশে একটি সভ্য, সুশীল ও উন্নত সমাজ গড়ে উঠতে পারে। সেজন্য বর্তমানের পাতি বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে অর্থলোলুপ ও নারীলোলুপ যে শ্রেণি গড়ে উঠেছে, তাদের দমন করা দরকার। তারা শুধু যে নারীঘটিত কেলেঙ্কারিতে যুক্ত তা নয়, তারা অবৈধ অর্থ পাচার, অবৈধ আদম ব্যবসাসহ নানা গুরুতর অপরাধে জড়িত। এই অপরাধীরা আবার ছোট-বড় মাফিয়া শ্রেণিতে বিভক্ত। এই নীতিহীন, চরিত্রহীন শ্রেণিটিকে ক্ষমতা বিস্তারের সুযোগ দিলে সরকারের সব উন্নয়ন পরিকল্পনাই ব্যর্থ হবে। পরীমনি নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য তার ঘটনাটি চাপা দিয়ে না রেখে সাহসের সঙ্গে প্রকাশ করায় তাকে ধন্যবাদ জানাই। তার মতো আরো অনেকের মি-টু আন্দোলন করে বাইরে বেরিয়ে আসা উচিত। সরকারের উচিত আমাদের নাইট ক্লাবগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ কঠোর করা। সামাজিক অবক্ষয় এক দিনে দূর করা যাবে না। এখন থেকেই সরকার যদি এ ব্যাপারে সজাগ হয়, তাহলে আমাদের পাতি বুর্জোয়া শ্রেণির লোভ থেকে সমাজ যেভাবে বাঁচবে, তেমনি আমাদের নারী সমাজকেও তাদের লোলুপতা থেকে একেবারেই না হোক, অনেকটা বাঁচাতে পারবে। আমাদের সমাজের নিম্ন পর্যায়েও নারী নিগ্রহ রয়েছে। অনেক সময় দেখা যায়, একেবারেই তরুণী নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ধানখেতে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। মফস্বলের শহরাঞ্চলেও নারী নিয়ে কেলেঙ্কারি ঘটে। সে ক্ষেত্রে অপরাধীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শাস্তি পায় না। তারা রাজনৈতিক প্রভাব অথবা ক্ষমতার প্রভাবে আত্মরক্ষা করে। থানার পুলিশ তাদের কিছুই করতে পারে না। কারণ থানার পুলিশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। খবরের কাগজে এখন বিভিন্ন উপজেলা চেয়ারম্যান, পুত্র, আত্মীয়স্বজনের অবাধ দুর্নীতির কথা প্রকাশ পায়। তার মধ্যে নারী নির্যাতন রয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের জোরে তারা শাস্তি এড়ায়। এটাও বর্তমান সরকারের জেনে রাখা উচিত, সমাজের নিম্ন শ্রেণিতে প্রসারিত লুটপাট ও নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে একশ্রেণির উপজেলা চেয়ারম্যান এবং তাদের পুত্রসন্তানদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। এরা গ্রামের পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি। এদের জন্ম আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রী আমলে। তখন উন্নয়নের নামে মৌলিক গণতন্ত্রীদের হাতে যে টাকাপয়সা দেওয়া হয়েছিল, তার অবাধ লুটপাট দ্বারা এই গ্রাম্য পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এরা আরো শক্তিশালী হয়েছে। এদের ভেতর থেকেই বর্তমান আমলের উপজেলা চেয়ারম্যানদের বেশির ভাগ নির্বাচিত হয়েছে। তারা নির্বাচিত হয়েছে যতটা জনগণের মনোনয়নে, তার চাইতে বেশি ধন-দৌলত নির্বাচনে জয়ী হতে তাদের সাহায্য করেছে। এখন তারাই গ্রাম্য পাতি বুর্জোয়া শ্রেণি। স্কুল-কলেজের সুন্দরী বালিকা ও তরুণীরাও এদের চোখ এড়ায় না। রাজধানীর নারীদের তবু নিরাপত্তা আছে, এদের কোনো নিরাপত্তা নেই। এদের ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ কোথাও ফেলে দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা নিরাপদ আশ্রয়ে রক্ষা পায়। এজন্য আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতা প্রদান প্রয়োজন, যাতে তারা এই সমাজশত্রুদের দমন করতে পারে। বঙ্গবন্ধু যে সুন্দর শ্রেণিহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজকের বাংলাদেশের সমাজ তা নয়। তার বিপরীত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উচিত সামাজিক অবক্ষয়ের এই দিকটিতেও নজর দেওয়া এবং সমাজে একটি ব্যাপক শুদ্ধি আন্দোলন গড়ে তোলা। |