শিরোনাম: |
'গরিবের জন্যই আইন কড়া'
|
স্টাফ রিপোর্টার:
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ মোড়। রোববার দুপুর ১টা। যাত্রীবিহীন খালি রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন আজিজুল হক। ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল দৌড়ে আটকালেন তার রিকশা। মুহূর্তেই রিকশার পেছনের সিট তুলে রেখে দিলেন ট্রাফিক বপে আর রিকশাটি উল্টে রাখলেন রাস্তার পাশে। তার অপরাধ, কঠোর লকডাউনে রিকশা চালিয়ে আইন ভঙ্গ করেছেন। প্রায় এক ঘণ্টার আকুতিতেও মিলল না রিকশা। নিরুপায়, বিমর্ষ আজিজুল হক বসে পড়লেন ফুটপাতে। ধুলোমাখা মুখ। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। গরমে ঘাম ঝরছে, শরীরজুড়ে ক্লান্তি। ফুটপাতে বসেই কথা হচ্ছিল ষাটোর্ধ্ব আজিজুল হকের সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বললেন, 'আইন শুধু গরিবের জন্য কড়া। যখন রিকশা জব্দ করা হয়, তখন অনেক চার চাকার গাড়িই সামনে দিয়ে চলে গেছে। দেখেন, এখনও যাচ্ছে। কিন্তু তাদের গাড়ি আটকানো হয় না। গরিব বলে সব দোষ আমাদের।' দুপুর ২টায় মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড গিয়েও দেখা যায় একই চিত্র। একটি রিকশা উল্টে রেখেছে পুলিশ। আর এক ট্রাফিক কনস্টেবলের পেছন পেছন ঘুরছেন রিকশাচালক। একপর্যায়ে কান্না শুরু করেন নুর হোসেন। ৫০ বছর বয়সী এই রিকশাচালকের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন ১০ বছর ধরে। স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে রায়েরবাগে একটি ছোট ঘর ভাড়া করে থাকেন। নুর হোসেন বলেন, 'রিকশা চালিয়েই ছয়টি পেট চলে। অভাব হলেও তিনবেলা খাবার জুটে যেত। কিন্তু টানা লকডাউনে সব থমকে গেছে। গত কয়েক দিন ঘরেই ছিলাম। কিন্তু পেট আর মানছে না। ক্ষুধার কষ্টে ছেলেমেয়ে কাঁদছে। ওদের কান্না দেখে ঘরে বসে থাকতে পারলাম না। সকালে রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি। সকাল থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়েছে। কিন্তু এখন পুলিশের হাতে ধরা খেতে হলো।' রিকশা হারিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন নুর হোসেন। রাজধানীর ব্যস্ত সড়ক ফার্মগেট এখন একেবারেই অচেনা। অন্য সময় মানুষ আর যানবাহনে ঠাসা থাকে এই এলাকা। লকডাউনের কারণে এখন ফাঁকা। ব্যক্তিগত গাড়ি আর রিকশা দেখা যায় মাঝেমধ্যে। ফার্মগেটে পুলিশের চেকপোস্টে রোববার বিকেল ৩টায় দেখা গেল, কয়েকটি রিকশা উল্টো করে রাখা। রিকশাচালকদের মিনতিতেও মন গলছে না পুলিশের। এখানে কথা হয় রিকশাচালক কামাল উদ্দিনের সঙ্গে। শেরপুর থেকে আসা কামাল উদ্দিন স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে থাকেন তেজগাঁওয়ের একটি বস্তিতে। রিকশার মালিককে খরচ দিয়ে লকডাউনের আগে চার-পাঁচশ টাকা দৈনিক আয় হতো। আর সংসার সচল রাখতে তার স্ত্রীও দুটি বাসায় কাজ করেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে স্ত্রীও এখন বেকার। দু'জনেরই রোজগার এখন শূন্য। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে চারজনের সংসার চালাতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই গত শনিবার থেকে রাস্তায় নেমেছেন। প্রথম দিন ২০০ টাকা আয় করেছেন। কিন্তু রোববার ফার্মগেটে আসার পরপরই পুলিশ রিকশা আটক করেছে কামালের। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, 'এখন উপরওয়ালার দিকেই তাকিয়ে আছি, রিকশাটি যদি একবার ছাড়াতে পারি!' এখানে দায়িত্বরত পুলিশের এক এএসআই বলেন, করোনা মোকাবিলায় বন্ধ রাখা হয়েছে সব রকম গণপরিবহন ব্যবস্থা। রিকশাও এর মধ্যে পড়েছে। তাই এদের রিকশা জব্দ করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অনুমতি দিলে রিকশা ছেড়ে দেওয়া হবে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে একটি রিকশা গ্যারেজে গিয়ে দেখা গেল, বেশিরভাগ রিকশা অলস পড়ে আছে। লকডাউনের কারণে গ্রামে বা পরিবারের কাছে ফিরতে পারেননি অনেকে। উপার্জন একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পেট চালানো মুশকিল হয়ে উঠেছে। সরকারি খাদ্য সহায়তাও জোটেনি। খলিল উল্যাহ নামের এক রিকশাচালক বলেন, করোনা ও পুলিশের ভয় উপেক্ষা করে দু'দিন রাস্তায় বের হয়েছি। দু'দিনে মাত্র ১৮০ টাকা আয় করেছেন। রাস্তায় মানুষ নেই। সারাদিন ঘুরেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তার মাথায় রিকশাচালক আবদুর রাজ্জাক বসে আছেন এক ঘণ্টা ধরে। একজন যাত্রীও পাননি তিনি। বলেন, 'লকডাউন আমাগো পেটে লাথি মারছে। সারাদিনে রোজগার কী হইব, বুইঝা গেছি। খামু কী, কন?' পুরো ঢাকা শহরেই এখন এই চিত্র। রিকশাচালকদের অনেকেরই প্রশ্ন, এভাবে আর কত দিন চলবে? করোনায় আক্রান্ত না হলেও হয়তো অনাহারে মরতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য না মিললে তাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল হবে। রিকশা ভাড়া দেওয়া যাদের পেশা, তারাও পড়েছেন বিপাকে। রিকশাচালকদের কাছে 'মহাজন' হিসেবে পরিচিত এদের আয়ও প্রতিদিন শূন্যের দিকে নামছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ বা বিলস ২০১৯ সালে এক গবেষণায় জানায়, ঢাকায় রিকশার সংখ্যা ১১ লাখের মতো। দিনে একটি রিকশা দুই শিফটে চলে। রিকশাচালকের সংখ্যা সে হিসাবে আনুমানিক ২২ লাখের মতো। ঢাকার এসব রিকশার ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অন্তত ২৭ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে বলে গবেষণায় জানা যায়। এই বিশাল সাধারণ জনগোষ্ঠীকে দ্রুত আর্থিক সহায়তা দেওয়া জরুরি বলে মনে করেন জাতীয় শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক ও বিলসের উপদেষ্টা নাঈমুল আহসান জুয়েল। |