মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, 2০২4
মুজিববর্ষে মুজিবনগরের অবস্থান কোথায়?
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
Published : Sunday, 18 April, 2021 at 8:15 PM

(শনিবার) ছিল মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালে এই দিন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে আম্রকাননে বাংলাদেশের জাতীয় নেতারা সমবেত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাতেই স্বাধীনতা ঘোষণার আনুষ্ঠানিক সম্মেলনে অস্থায়ী স্বাধীন বাংলা গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ শপথ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাকে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় আনুষ্ঠানিকতা দান করা হয়। মেহেরপুরের এই অংশের নামকরণ হয়—মুজিবনগর।
বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা তখন পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী দ্বারা অধিকৃত। ভারত সীমান্তবর্তী কুষ্টিয়ার মেহেরপুরকেই স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাজধানী করার তুলনামূলক নিরাপদ স্থান মনে করা হয়। গোটা কুষ্টিয়াসহ মেহেরপুর ছিল অবিভক্ত নদীয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৪৭ সালে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদে নদীয়া জেলা বিভক্ত হয় এবং মেহেরপুরসহ কুষ্টিয়া পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে।
যদিও আমি বৃহত্তর বরিশাল জেলার লোক। কিন্তু নদীয়া জেলা এবং মেহেরপুর ছিল কৈশোর কাল থেকেই আমার পরিচিত। বিখ্যাত রহস্য উপন্যাসিক দীনেন্দ্র কুমার রায়ের বাড়ি ছিল নদীয়ার মেহেরপুর। তার ‘ব্লেকস্মিথ সিরিজের’ রহস্য উপন্যাস ছিল সারা বাংলাদেশে পঠিত। আমিও কৈশোরে এই উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছি। দীনেন্দ্র কুমার রায়ের মৃত্যুর পর তার ছেলে দীপ্তেন্দ্র কুমার রায় বাংলা ভাগ না হওয়া পর্যন্ত মেহেরপুরেই ছিলেন এবং তার পিতার লেখা শতাধিক রহস্য উপন্যাস মেহেরপুরে বসেই বিক্রি করতেন। কেবলমাত্র তার নাম লিখে মেহেরপুর নদীয়া লিখে চিঠি পাঠালেই তার কাছে পৌঁছে যেত এবং তিনি বই পাঠাতেন। আমিও এভাবে আমার কৈশোরে বহু বই আনিয়েছি।
সুতরাং নদীয়া জেলা থেকে বিভক্ত হয়ে কুষ্টিয়াসহ পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া মেহেরপুর নামটি আমার পরিচিত ছিল। স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাজধানী হওয়ায় মেহেরপুর নামটি আমার কাছে আরো পরিচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মেহেরপুর ও বৈদ্যনাথতলা দেখার সুযোগ হয়। তার আগে নয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বহু বিশিষ্ট ব্রিটিশ এমপি ও মন্ত্রী, মার্কিন সিনেটর মেহেরপুর পরিদর্শন করেন। ফলে মেহেরপুরের মানুষ স্থানটি নতুন দেশের রাজধানী হবে ভেবে আশায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিল। তাদের সেই আশা অবশ্য স্বাভাবিক কারণেই পূর্ণ হয়নি। সেই নবাবি আমল থেকে ঢাকা কখনো সুবে বাংলার রাজধানী অথবা উপরাজধানী। সুতরাং ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে—এটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল এবং সেটাই হয়েছে।
তবু আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে ফিলাডেলফিয়া শহরের যে গুরুত্ব, সেই গুরুত্ব বাংলাদেশের মেহেরপুরের। আমেরিকার স্বাধীনতা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়েছিল ফিলাডেলফিয়া শহর থেকে। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে তাই ফিলাডেলফিয়া শহরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মেহেরপুর নামের উল্লেখ আছে। মেহেরপুরকেই যে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর নামকরণ হয়েছে, তারও উল্লেখ আছে। তার বেশি গুরুত্ব মুজিবনগর পায়নি।
স্বাধীনতার সংগ্রাম চলাকালে মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানীরূপে ঘোষিত হলেও সেখানে রাজধানীর সব কাজকর্ম করার কোনো সুবিধা এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীদের নিরাপত্তা রক্ষার কোনো সুব্যবস্থা ছিল না। সুতরাং মিত্র ও সহযোদ্ধা দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা শহরেই থিয়েটার রোড, সার্কাস এভিনিউ, বালিগঞ্জ, পার্ক সার্কার্স, বালু হাক্কাক লেন প্রভৃতি এলাকায় সরকারি অফিস ও মন্ত্রীদের থাকার জায়গা নির্ধারিত হয়েছিল। অস্থায়ী মুজিবনগর সরকারের সাপ্তাহিক মুখপত্র জয়বাংলার মাস্টহেড প্রথম এঁকেছিলেন শিল্পাচার্য কামরুল হাসান, পরে এঁকেছিলেন শিল্পী ও কবি পূর্ণেন্দুপত্রী। পত্রিকাটি ছাপা হতো কলকাতার মানিকতলার একটি প্রেসে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ ফিরে আসার পর ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় গিয়েছিলেন। ময়দানে তার জনসভায় যোগ দেওয়ার জন্য সারা কলকাতা শহর খালি হয়ে গিয়েছিল। রাজভবন বা গভর্নর হাউসে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তাতে কলকাতার এমন কোনো ছোট-বড় শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতা ছিলেন না, যারা এই সংবর্ধনায় যোগ দেননি। মহানায়িকা সুচিত্রা সেন বঙ্গবন্ধুর গলায় মালা পরিয়েছেন।
কলকাতার এসব স্থান এবং ঘটনারও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সামান্য উল্লেখও হয়নি। অথচ হিটলার গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে গোটা ফ্রান্স দখল করে নেওয়ার পর ফ্রান্সের তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধের নায়ক জেনারেল দ্যগলে লন্ডনে এসে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেছিলেন লন্ডনের এক শহরতলিতে। স্থানটির তিনি নাম দিয়েছিলেন নিউ প্যারিস। এই নিউ প্যারিসের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং ফরাসিরা তাদের রেজিস্টেন্স মুভমেন্টের ইতিহাসে এর উল্লেখ করতে লজ্জাবোধ করেনি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের আশ্রয়দাতা এবং অকৃত্রিম বন্ধু ছিল। সুতরাং তাদের কোনো শহরে, যে শহরটি অবিভক্ত বাংলার রাজধানী ছিল, সেখানে অস্থায়ী গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের কার্যক্রম অস্থায়ীভাবে চলেছিল; তা স্বীকার করলে আমাদের লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে কি? একটি মাত্র কারণ থাকতে পারে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সাহায্য ছিল এবং এই স্বাধীনতার বিরোধী দেশগুলো বাংলাদেশকে ‘ভারতের দাস’ বলে প্রচার করবে এই সম্ভাবনা এড়ানো। কিন্তু এই সম্ভাবনা এড়ানো গিয়েছিল কি? বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া এবং ভারতের সৈন্য বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়ার পরও কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধী দেশগুলো বাংলাদেশকে ‘ভারতের দাসরাষ্ট্র’ হিসেবে মিথ্যা প্রচার চালায়নি? তাতে কি তারা সফল হয়েছিল? আর এ-ও কি সত্য নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতের ২০ হাজার সৈন্য আত্মদান করেছিল?
বিএনপি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা করেছে, সফল হয়নি। আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃত করেনি। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক ইতিহাসের কিছু সত্য চেপে রেখেছে। তাতেও তারা সফল হবে না। ইতিহাস নিজের শক্তিতে এবং নিজের প্রয়োজনেই একদিন সব সত্য অনাবৃত করবে। সেদিন জানা যাবে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ফিলাডেলফিয়ার যেমন গুরুত্ব, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে মেহেরপুর বা মুজিবনগরের তেমনই গুরুত্ব। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ এবং তৎকালীন ফ্রান্সের সমর্থন (স্টাচু অব লিবার্টিসহ) যেমন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকৃত এবং ইতিহাসে সংরক্ষিত; তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুজিবনগর ও কলকাতার ঐতিহাসিক ভূমিকা এবং অবদানও একদিন দেশটির ইতিহাসে সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃত হবে। মুজিব বর্ষে মুজিব নগর যে গুরুত্ব পায়নি, সে গুরুত্ব পাবে অদূর ভবিষ্যতে।
মুজিবনগরকে যে আমরা একেবারে অগ্রাহ্য করেছি তা নয়। তাতে কিছু স্থাপনা আছে। মুজিববর্ষ পালনেও মুজিবনগরকে কিছুটা ‘চন্দ্র বণিকের বা হাতে মনসা পুজা দেওয়ার মতো’ সম্মান দেখানো হয়েছে। তার বেশি কিছু নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতার যে স্থানগুলোতে ছিল মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীদের বাসস্থান ও অফিস, বালিগঞ্জে যেখানে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তা ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনাক্রমে ‘সংরক্ষিত স্থান’ করা উচিত ছিল। মুজিবনগরকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় রাজধানী হিসাবে স্বীকৃত দিয়ে কিছু সরকারি অফিস-আদালত সেখানে স্থানান্তর করা হলে স্থানটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রক্ষিত হতো। মুজিব নগরে মুক্তিযুদ্ধসম্পর্কিত জাদুঘরটির উন্নতি ও সম্প্রসারণও অত্যাবশ্যক। এটির প্রতি অবহেলা করা উচিত নয়।


সর্বশেষ সংবাদ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
প্রতিষ্ঠাতা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল হাজারী।   ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: গোলাম কিবরীয়া হাজারী বিটু্।   প্রকাশক: মোঃ ইব্রাহিম পাটোয়ারী।
সহ সম্পাদক- রুবেল হাসান: ০১৮৩২৯৯২৪১২।  বার্তা সম্পাদক : জসীম উদ্দিন : ০১৭২৪১২৭৫১৬।  সার্কুলেশন ম্যানেজার : আরিফ হোসেন জয়, মোবাইল ঃ ০১৮৪০০৯৮৫২১।  রিপোর্টার: ইফাত হোসেন চৌধুরী: ০১৬৭৭১৫০২৮৭।  রিপোর্টার: নাসির উদ্দিন হাজারী পিটু: ০১৯৭৮৭৬৯৭৪৭।  মফস্বল সম্পাদক: রাসেল: মোবা:০১৭১১০৩২২৪৭   প্রকাশক কর্তৃক ফ্ল্যাট নং- এস-১, জেএমসি টাওয়ার, বাড়ি নং-১৮, রোড নং-১৩ (নতুন), সোবহানবাগ, ধানমন্ডি, ঢাকা থেকে প্রকাশিত এবং সিটি প্রেস, ইত্তেফাক ভবন, ১/আর কে মিশন রোড, ঢাকা-১২০৩ থেকে মুদ্রিত।  বার্তা, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন বিভাগ: ০২-৪১০২০০৬৪।  ই-মেইল : [email protected], web : www.hazarikapratidin.com
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি