শিরোনাম: |
‘পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কি না খায়’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
|
![]() বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই রাজনৈতিক বাকুনদের উৎপাত অনেক আগেই শুরু হয়েছিল, বর্তমানে তা আরো বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। এরা একেক সময় একেক হুজুগ নিয়ে রাস্তায় নামে। তাতে দেশের মানুষের উপকার হয় না, অপকার হয়। মৌলবাদীদের ভাস্কর্য নিয়ে মাতামাতিতে এরা কিছুদিন পেছন থেকে উসকানি দিয়েছে। তাতে সফল হয়নি। এখন নতুন হুজুগ করোনার টিকা নিয়ে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই প্রচারণা ধোপে টেকেনি। দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য—এই দুইটি উন্নত দেশের চেয়েও বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণের কাজে অনেক সফল। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য দুইটি দেশই করোনা ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করেছে। রাশি রাশি টাকা খরচ করে এ দুইটি দেশকে টিকা আমদানি করতে হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও এই দুইটি দেশেই করোনায় মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। করোনা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাকুনদের প্রচারণাতেও সাধারণ মানুষ কান দেয়নি। কারণ, এই সোশ্যাল মিডিয়ার আধিপত্যের যুগে জনসাধারণের কাছে কোনো সত্য এবং অসত্যও গোপন রাখা কঠিন। দেশের এবং বহির্বিশ্বের মানুষ যখন বাংলাদেশের করোনা নিয়ন্ত্রণকে প্রশংসা করল তখন এই বাকুনেরা এবং তাদের অভিভাবকেরা আবার এক ধুয়া তুলল। সরকার বেশি দাম দিয়ে ভারত থেকে করোনার টিকা আনছে। এই টিকা দেহে করোনা প্রতিহত করে না, বরং তা শরীরে মারাত্মক রোগের সৃষ্টি করে। এমন কথাও বলা হলো—এই টিকা নিলে মহিলাদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতি শিবির থেকে এই ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত মিথ্যা প্রচার চালাতে কোনো দ্বিধা দেখানো হয়নি। করোনার মতো বিশ্বধ্বংসী মহামারি রোধে যখন সব রাজনৈতিক বিবেচনা ভুলে বিএনপি, সুশীল সমাজ—সবারই জনগণের পাশে এসে দাঁড়ানো এবং তাদের মনে সাহস জোগানো দরকার ছিল, তখন তারা এই মহামারিকেও তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের ইস্যু করার চেষ্টা করছেন। করোনার বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ সফল করার কাজে সাহায্য করার বদলে ব্যর্থ করার জন্য চক্রান্ত চালাচ্ছেন। এটা সরকারের বিরোধিতা নয়, জাতিদ্রোহিতা। ব্রিটেন বা ফ্রান্সের মতো দেশ হলে এদের পঞ্চমবাহিনী আখ্যা দিয়ে বিচার হতো। বাংলাদেশ করোনার টিকা এনেছে তা ভারতে উৎপাদিত হলেও অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি এই টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের সুযোগ কম। যেমন আমেরিকার ফাইজারের টিকা নিতেও কেউ আপত্তি করছে না। যদিও এই টিকা গ্রহণে কোনো কোনো দেশে একাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে। এই টিকা বাংলাদেশে আনা হলে বিএনপির নেতারা কী প্রোপাগান্ডা চালাতেন তা সহজেই অনুমেয়। রাজনৈতিক স্বার্থে ও উদ্দেশ্যে দেশের মানুষের মনে জীবন-রক্ষাকারী প্রতিষেধক গ্রহণে সন্দেহ সৃষ্টি মানুষেরই কত বড় শত্রুতা তা খবরের কাগজে প্রবন্ধ লিখে বোঝানো যাবে না। বিশ্ববিখ্যাত নাট্যকার ইবসেন এদের নিয়ে নাটক লিখে এদের আখ্যা দিয়েছেন—পিপল্স এনেমি বা গণশত্রু। এই গণশত্রুদের নেতা বহুরূপী বৃদ্ধ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বিএনপির অভিভাবক; কিন্তু ভাব দেখান তিনি জাতির অভিভাবক। তিনি দেশের সব ব্যাপারে নাক গলান এবং তাতে হীতে বিপরীত হয়। তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সম্ভবত লন্ডনে ছিলেন। সেই সুবাদে লন্ডনে বাংলাদেশের ছাত্ররা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠনে যে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছিল, সম্প্রতি তার ইতিহাস বলার নামে আবোল-তাবোল বলেছেন। লন্ডনে এই ছাত্র-আন্দোলনের প্রত্যক্ষদর্শী বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরী মানিক তার এই বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। জেনারেল এরশাদ প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি ছিলেন তার একজন খয়েরখা। এরশাদ সাহেবকে দিয়ে তিনি এমন এক ঔষধ নীতি প্রণয়ন করিয়েছিলেন, যাতে দেশে মানুষের দুর্গতির অন্ত ছিল না। তিনি সব সরকারেরই কাঁধে থাকতে চান। এরশাদের পর বিএনপির কাঁধে চেপেছেন। সুযোগ পেলে আওয়ামী লীগেরও গার্জিয়ান হতেন। আওয়ামী লীগ সে সুযোগ তাকে দেয়নি। বুড়ো হলে ভামে ধরে বলে বাংলায় একটা প্রবাদ আছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে বৃদ্ধ বয়সের এই রোগে ধরেছে কি না—জানি না। তিনি একবার বলেছেন, এই টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে জনগণের মনে আস্থা সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে টেলিভিশনের সামনে প্রথম টিকা নিতে হবে। তারপর দুই দিন না যেতেই বলেছেন, ‘ভারতে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজনেকার তৈরি করোনা ভাইরাসের যে টিকা বাংলাদেশে এসেছে, তা নিয়ে ভয়ের কারণ নেই। প্রথম দিকে তার নাম এলে তিনি নিজেও টিকা নিতে রাজি।’ তাই যদি হবে, তাহলে প্রথমে এই টিকা সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে কথা বলা কেন? তারপর এই টিকা নিজে নেওয়ার আগে আগ বাড়িয়ে তার কার্যকারিতার সার্টিফিকেট দেওয়া কেন? এর পেছনেও কোনো বাণিজ্যনীতি নেই তো? জাফরুল্লাহ চৌধুরী এখন আমদানিকৃত করোনার টিকা সম্পর্কে তার কথা পালটাতে পারেন; কিন্তু এই ব্যাপারে তার ‘বয়স্ক-শিশু’ অনুসারীদের কানে যে মন্ত্রটি দিয়ে গেছেন তা তারা এখন আওড়াতে শুরু করেছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দাবি জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের প্রথম ডোজ রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে নিতে হবে। কেন নিতে হবে তার কারণ দর্শাতে গিয়ে তিনি একটি ডাহা মিথ্যা কথা বলেছেন। আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মিথ্যা বলার দুর্নাম আছে; কিন্তু তিনিও এত বড় মিথ্যা বলতে দ্বিধাবোধ করতেন। রিজভী বলেছেন, ‘পৃথিবীর দেশে দেশে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা যেভাবে টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে মানুষের মনে আস্থা ও ভরসা সৃষ্টি করেছেন, আপনারা সেই পথ অনুসরণ করুন। তাদের মতো আপনারাও সাহসী পদক্ষেপ নিন।’ গোড়াতেই গলদ। রিজভী সাহেব হয় অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ওপরের কথাটি বলেছেন, নয়তো এটা তার মহামূর্খতার পরিচায়ক উক্তি। পৃথিবীর কোনো দেশেই রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা কোনো মন্ত্রী প্রথম এই টিকার ডোজ নেননি। ব্রিটেনের টিকার প্রথম ডোজ রানী অথবা প্রধানমন্ত্রী—কেউ নেননি। প্রথম ডোজটি সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ৯০ বছরের বৃদ্ধকে। খবরটি বৃদ্ধের ছবিসহ খবরের কাগজে ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। রিজভী কি খবরের কাগজও পড়েন না? যদি তিনি খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসটা করতেন, তাহলে দেখতেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন টিকা নিয়েছেন আমেরিকায় টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার অনেক পরে। ভারতের মোদিও তাই। টিকা নিয়ে যখন এতই সংশয় তখন রিজভী-ফখরুল সাহেব এই টিকা নিয়ে সাহস দেখাতে পারেন। সেই সাহস তারা দেখাবেন না। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, একদিকে তারা টিকা নেওয়া সম্পর্কে জনমনে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা চালাবেন, অন্যদিকে নিজেরা যত দ্রুত সম্ভব এই টিকা নেওয়ার জন্য লাইন দেবেন। বিএনপি নেতাদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক নৃশংসতার পরিচয় পাওয়া গেছে তিন বছর ধরে দেশে মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার নৃশংসতা থেকে; কিন্তু তাদের মানসিক প্রবৃত্তিও কতটা নৃশংস, তার পরিচয় পাওয়া যায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে করোনার প্রথম ডোজ গ্রহণের দাবি জানানোর মধ্যে। মুখে তারা যাই বলুন, তাদের মনের আসল ইচ্ছা হয়তো, এই টিকা অকার্যকর ও জীবননাশক হলে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীই তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, লাভবান হবে বিএনপি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তারা সহজেই ক্ষমতায় গিয়ে বসতে পারবেন। ধন্য আশা কুহকিনী। অন্যদিকে করোনার টিকা দেশে আসার পর রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী যদি তা নেন, তাহলে এই রিজভী ও ফখরুল সাহেবরাই চিৎকার শুরু করবেন এবং দেশবাসীকে বলবেন, দ্যাখুন, দ্যাখুন আপনারাই দেখুন সরকারি টাকায় ভারত থেকে করোনার টিকা কিনে এনে ক্ষমতাসীন নেতারাই তা ভাগবাঁটোয়ারা করে নিচ্ছে। সাধারণ মানুষের কথা তাদের স্মরণ নেই। আমার এই অনুমান কতটা সত্য তার প্রমাণ দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল খলনায়ক জিয়াউর রহমানের ৮০তম জন্মবার্ষিকীর সভার বক্তৃতায়। তিনি বলেছেন, ‘করোনা ভাইরাসের টিকা সাধারণ মানুষ পাবে কি না—তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তবে ধনীরা যে টিকা পাবে তাতে সন্দেহ নেই।’ সচেতন মানুষ বিএনপি নেতাদের এই ধোঁকাবাজি সহজেই বুঝবে। এক নেতা বলছেন, এই টিকা প্রথম ক্ষমতাসীনদের নেওয়া উচিত। আরেক নেতা বলছেন, ক্ষমতাসীনেরা বা ধনীরাই প্রথম টিকা পাবে। সাধারণ মানুষ পাবে কি না—তা নিয়ে সন্দেহ আছে। |